রাজ্যে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে যাত্রী বহনকারী সব গাড়িতে বছর তিনেক আগে অবস্থান নির্ণায়ক যন্ত্র (ভেহিকল লোকেশন ট্র্যাকিং ডিভাইস বা ভিএলটিডি) বসানো বাধ্যতামূলক করেছিল সরকার। এই ব্যবস্থায় অ্যাপ-ক্যাব, স্কুলগাড়ি থেকে শুরু করে বেসরকারি বাস— সব ক্ষেত্রেই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে যাত্রী-সুরক্ষায় চালু হয়েছিল প্যানিক বাটন। সার্বিক এই ব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল, পথে বাণিজ্যিক গাড়ির প্রকৃত অবস্থান জানার পাশাপাশি কোনও অঘটন ঘটলে দ্রুত প্রশাসনিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়া।
কিন্তু, প্রায় দু’লক্ষ বাণিজ্যিক গাড়ি ওই ব্যবস্থার আওতায় আসার পরে এ বার কেন্দ্রের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থা সি-ড্যাকের বকেয়া প্রায় আট কোটি টাকা না মেটানোর জন্য ওই সংস্থার সার্ভার থেকে যে সব তথ্য মিলত, তা সম্প্রতি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সংস্থার পক্ষ থেকে রাজ্যের পরিবহণ দফতরকে চিঠি দিয়ে বকেয়া মেটানোর পাশাপাশি চুক্তি নবীকরণের কথা বলা হলেও রাজ্যের তরফে কোনও সাড়া মেলেনি বলেই অভিযোগ।
সি-ড্যাকের তরফে এ-ও অভিযোগ করা হয়েছে, গত ৮ জুলাই চুক্তির মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও তারা নতুন গাড়ি নথিভুক্ত করার পাশাপাশি ভিএলটিডি পরীক্ষা করার পরিষেবা চালু রেখেছিল। কিন্তু রাজ্যের তরফে চুক্তি নবীকরণ করা নিয়ে কিছুই জানানো হয়নি। এর পরেই গত ১৬ জুলাই সি-ড্যাক কর্তৃপক্ষ রাজ্যের পরিবহণ দফতরকে চিঠি দিয়ে এই পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার কথা জানান। সূত্রের খবর, এর ফলে বিপুল সংখ্যক বাণিজ্যিক গাড়িতে বসানো অবস্থান নির্ণায়ক যন্ত্রের কোনও কার্যকারিতা থাকবে না।
বাণিজ্যিক গাড়ির মালিকদের অভিযোগ, এই যন্ত্র বসাতে গিয়ে দু’বছরে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। অবস্থান নির্ণায়ক যন্ত্র না বসালে গাড়ির স্বাস্থ্য পরীক্ষার অনুমতি মেলে না। পারমিটও নবীকরণ হয় না। এখন এই সংক্রান্ত পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে মালিকদের প্রশ্ন, সরকারি নির্দেশ মেনে, টাকা গচ্চা দিয়ে যন্ত্র বসিয়ে কী সুবিধা হল?
রাজ্য পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, কেন্দ্রের নির্ভয়া প্রকল্পের আওতায় অবস্থান নির্ণায়ক যন্ত্র বসানোর ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। কেরলের পরে দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই এই যন্ত্র বসানো শুরু হয়। পুরো ব্যবস্থায় নজরদারি চালানোর জন্য পোদ্দার কোর্টে পরিবহণ দফতর কন্ট্রোল রুমও তৈরি করে।
এই ব্যবস্থায় রাস্তায় কোনও গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়লে সেই খবর কেন্দ্রীয় সার্ভারে পৌঁছত। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে কোনও যাত্রী প্যানিক বাটন টিপলে মূল সার্ভার ওই বার্তা বিশ্লেষণ করে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির অবস্থান-সহ নির্দিষ্ট সতর্কবার্তা পরিবহণ দফতরকে জানাত। পরিবহণ দফতর সেই বার্তা পাঠাত পুলিশের কাছে। কিন্তু অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে তৎপর হওয়া নিয়ে পুলিশ ও পরিবহণ দফতরের মধ্যে টানাপড়েন চলেছে। আরও অভিযোগ, পরিবহণ দফতরের হাতে থাকা গোটা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ পুলিশকে দেওয়ার পরেও রাজ্যে তার সফল রূপায়ণ হয়নি।
সি-ড্যাকের সঙ্গে চুক্তি নবীকরণ সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তীকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। টেক্সট মেসেজের উত্তর দেননি। তবে পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, রাজ্যে ওয়েবেল-এর মাধ্যমে অবস্থাননির্ণায়ক যন্ত্রের ব্যবস্থা কার্যকর রাখার প্রক্রিয়া চলছে। যদিও সি-ড্যাকের তুলনায় ওয়েবেলের দক্ষতা এবং পরিকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে পরিবহণ দফতরের আধিকারিকদের মধ্যেই। যে ব্যবস্থা রাজ্যে মহিলা, শিশু-সহ স্কুলপড়ুয়াদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হতে পারত, তার এমন ধুঁকতে থাকা অবস্থা হল কেন, সেই প্রশ্ন তুলছেন তাঁদের অনেকেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)