এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম নিয়ম নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তৃণমূলের অন্দরে। —ফাইল ছবি।
গত নভেম্বরের শেষে তৃণমূলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে দলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার্তা দিয়েছিলেন, পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে শৃঙ্খলার প্রশ্নে কোনও শিথিলতা দেখানো হবে না। গড়ে দিয়েছিলেন শৃঙ্খলারক্ষা কমিটিও। সে কমিটি যে শুধু কাগজে-কলমে নয়, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। দলের ‘বিড়ম্বনা’ তৈরির কারণে তিন নেতার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কিন্তু সেই একই সময়কালে তিন ‘খ্যাতনামী’ বিধায়ক-সাংসদ যা যা মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে এখনও পর্যন্ত দলের কোনও ভ্রূক্ষেপ না থাকায় প্রশ্ন উঠছে তৃণমূলের অন্দরে।
যে তিন নেতার ঘাড়ে দলের শৃঙ্খলার ‘কোপ’ পড়েছে, তাঁরা হলেন মুর্শিদাবাদের ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীর, উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা অশোকনগরের বিধায়ক নারায়ণ গোস্বামী এবং সর্বশেষ কামারহাটির তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্র। শৃঙ্খলার প্রশ্নে যে তিন অভিনেতা-জনপ্রতিনিধির ক্ষেত্রে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বুধবার পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না, সেই তালিকায় রয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুরের তৃণমূল বিধায়ক সোহম চক্রবর্তী, হুগলির সাংসদ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আসানসোলের সাংসদ শত্রুঘ্ন সিন্হা।
পুলিশ-প্রশাসন, রাজ্য সরকার এবং শাসকদলের পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতৃত্ব নিয়ে একের পর এক মন্তব্য করেছিলেন হুমায়ুন। আরজি কর-পরবর্তী পর্বে হুমায়ুনের বক্তব্য ছিল, এখনই উচিত অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে উপমুখ্যমন্ত্রী করে পুলিশ দফতর তাঁর হাতে তুলে দেওয়া। দল তা ভাল ভাবে নেয়নি। হুমায়ুনকে শো কজ় করেছিল তৃণমূল। দুঃখপ্রকাশ করে তার জবাব দিয়েছিলেন ভরতপুরের বিধায়ক।
দ্বিতীয়, নারায়ণ। সম্প্রতি অশোকনগরের একটি অনুষ্ঠানে মঞ্চে উঠে গান গেয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন বেশ কিছু অসংলগ্ন কথাও। অনুষ্ঠান মঞ্চের ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে সমাজমাধ্যমে (ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন), যা দলকে বিড়ম্বিত করেছিল। নারায়ণকেও শো কজ় করেন দলীয় নেতৃত্ব। দলের প্রবীণ নেতা তথা মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মৌখিক ভাবে কথা বলে নারায়ণ বিষয়টি মিটমাট করে নিতে চাইলেও দল রেয়াত করেনি। লিখিত জবাবই দিতে হয় তাঁকে। যেখানে নারায়ণ লিখেছেন, এ যাত্রায় তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া হোক।
সর্বশেষ উদাহরণ মদন। তৃণমূলের পরামর্শদাতা সংস্থা আইপ্যাকের উদ্দেশে সরাসরি ‘তোলাবাজি’ করার অভিযোগ করেছিলেন কামারহাটির বিধায়ক। তবে তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও পদক্ষেপ করার আগে মদন নিজেই ক্ষমাপ্রার্থনা করে চিঠি লিখে দেন রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীকে। কিন্তু তার নেপথ্যে যে দলের ‘চাপ’ ছিল, তা স্পষ্ট হয়ে যায় মদনের চিঠির সংখ্যা, ভাষা এবং বয়ানে। প্রথমটি ইংরেজিতে। দ্বিতীয়টি বাংলায়। দু’টি চিঠিই প্রকাশ্যে আসে। ইংরেজি চিঠির বিষয়বস্তু ছিল যে, তাঁর কিছু কথা নিয়ে সংবাদমাধ্যম বিভ্রান্তিকর প্রচার করছে। তিনি কিছু কথা বলেছেন ঠিকই। কিন্তু জ্বর ও অন্য অসুস্থতার কারণে গোলমাল হয়ে গিয়েছে। তিনি ও ভাবে বলতে চাননি। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করেন, সেই সব ব্যাখ্যার মধ্যে তাঁর ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টিই ‘লঘু’ হয়ে গিয়েছে। দল তাঁকে বার্তা দেয়, এ সব কথায় ‘চিঁড়ে ভিজবে না’। বার্তা পেয়ে ইংরেজি থেকে বাংলায় ফেরেন মদন। স্পষ্ট লেখেন যে, তিনি ক্ষমা চাইছেন। তাতে জ্বরজ্বালার আর উল্লেখ ছিল না। সংবাদমাধ্যমের উপরেও দোষারোপ ছিল না।
পর পর তিনটি ঘটনার প্রেক্ষাপটেই সোহম, রচনা, শত্রুঘ্নদের নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তৃণমূলের অন্দরে। কারণ, তৃণমূলের প্রথম সারির অনেক নেতা মনে করেন ওই তিন ‘খ্যাতনামী’ যা যা বলেছেন, তাতে দলীয় লাইন ‘লঙ্ঘিত’ হয়েছে। আরজি করের ধর্ষণ-খুনের মামলার রায় নিয়ে সোহমের মন্তব্য ছিল, তিনি মনে করেন না, সাজাপ্রাপ্ত সঞ্জয় রায় একা ওই কাজ করেছে। অনেকের মতো তাঁরও মনে হয়, ঘটনার সময়ে আরও অনেকে ছিল। ঘটনাচক্রে, আরজি করের ঘটনা নিয়ে তৃণমূল (দলই হোক বা প্রশাসন) আগাগোড়া বলে এসেছে, ওই ঘটনায় অভিযুক্ত এক জনই— সঞ্জয়। প্রাথমিক ভাবে কলকাতা পুলিশ এবং পরে সিবিআইয়ের তদন্তও সেই দিকেই নির্দেশ করেছে, যা শাসক শিবিরের পক্ষে ‘স্বস্তিজনক’ হয়েছে। সেই আবহে ওই ‘স্পর্শকাতর’ বিষয়ে সোহমের মন্তব্য দলীয় লাইনের পরিপন্থী বলেই মনে করেন দলের অনেকে। কিন্তু দল ওই বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ এখনও পর্যন্ত করেনি।
দ্বিতীয়ত, কুম্ভমেলায় পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসনকে সংসদের ভিতরে-বাইরে কড়া সমালোচনায় বিদ্ধ করেছে তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া ছিল, গঙ্গাসাগর মেলার ব্যবস্থাপনা দেখে উত্তরপ্রদেশ সরকারের শেখা উচিত! কিন্তু সেই তৃণমূলেরই সাংসদ রচনা মহাকুম্ভে স্নান সেরে যোগীর ব্যবস্থাপনা দেখে অভিভুত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বলেছেন ‘তুলনাহীন ব্যবস্থাপনা’। যা নিয়ে তৃণমূলের সংসদীয় দলের মধ্যেও আলোচনা শুরু হয়েছে। রচনাকে দলীয় নেতৃত্বের তরফে কিছু বলা হয়েছে, এমন খবর বুধবার দুপুর পর্যন্ত নেই। তবে লোকসভায় তৃণমূলের মুখ্যসচেতক কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘কেউ ব্যক্তিগত ভাবে কী বললেন, তাতে কিছু যায়-আসে না। দলগত ভাবে আমরা মনে করি, বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকারের অপদার্থতার জন্য অসংখ্য মানুষের প্রাণ গিয়েছে। ওরা মৃত্যুর সংখ্যা গোপন করেছে।’’
তৃতীয় এবং এখনও পর্যন্ত সর্বশেষ উদাহরণ শত্রুঘ্ন। মঙ্গলবার কার্যত বিজেপির ‘লাইনে’ কথা বলেছেন আসানসোলের তৃণমূল সাংসদ। ঘটনাচক্রে, শত্রুঘ্ন একদা বিজেপির সাংসদ এবং কেন্দ্রে মন্ত্রী ছিলেন। যদিও তিনি বলেন, বাজপেয়ী-আডবাণীর বিজেপি আর মোদী-শাহের বিজেপি এক নয়। তিনি মঙ্গলবার সাফ বলেছেন, গোটা দেশেই আমিষ খাবার নিষিদ্ধ করা উচিত! উত্তরাখণ্ডে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার ইতিমধ্যেই ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ চালু করেছে। মঙ্গলবার অভিন্ন দেওয়ানি বিধি শুরু করার বিষয়ে কমিটি গঠন করেছে গুজরাত সরকারও। ওই বিধির প্রশংসা করেছেন শত্রুঘ্ন। বলেছেন, ‘‘শুধু গোমাংসই নয়, দেশে সমস্ত আমিষ পদই নিষিদ্ধ করা উচিত। সরকার বিভিন্ন জায়গায় গোমাংস বিক্রি বন্ধ করেছে। তবে এখনও অনেক জায়গায় গোমাংস বিক্রি বা খাওয়ায় কোনও আইনি বাধা নেই। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ প্রকাশ্যেই তা খেতে পারেন। কিন্তু উত্তর ভাবতের মানুষ পারেন না। তাঁর কথায়, ‘‘উত্তর-পূর্বে গোমাংস খেলে ইয়াম্মি আর উত্তর ভারতে খেলে মাম্মি! এটা তো হতে পারে না!’’ শত্রুঘ্নের সওয়াল, যে আইন উত্তর ভারতে রয়েছে, সেই একই আইন চালু হওয়া উচিত উত্তর-পূর্বেও। কারণ, দেশ একটিই।
উল্লেখ্য, শত্রুঘ্নের দলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের কথা বলেন। অভিযোগ করেন, পোশাক, ধর্ম, খাদ্যাভাস নিয়ে মানুষের উপর ‘নিয়ন্ত্রণ’ কায়েম করতে চায় বিজেপি। শত্রুঘ্নের বক্তব্য সেই বক্তব্যের পরিপন্থী। সেই সূত্রেই আলোচনা শুরু হয়েছে তৃণমূল সংসদীয় দলের অন্দরে। এক সাংসদ যেমন বলেছেন, ‘‘উনি আগে নিজের খাদ্যাভ্যাস এবং যাপন বদলান! তার পরে দেশের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে মতামত প্রকাশ করুন।’’ লোকসভায় শত্রুঘ্নের সতীর্থ কল্যাণ অবশ্য সরাসরিই বলেছেন, ‘‘কে কী খাবেন, কী পরবেন, তা অন্য কেউ ঠিক করে দিতে পারে না।’’ কিন্তু প্রশ্ন হল, দল কি শত্রুঘ্নের সঙ্গে ওই বিষয়ে কোনও আলোচনা করবে বা পদক্ষেপ করবে?
দলের অন্দরে আরও প্রশ্ন যে, রাজনীতি করে উঠে আসা নেতাদের কারণ দর্শাতে হলে অভিনেতারা কেন ‘ছাড়’ পাবেন? তিন নেতা দলীয় পদক্ষেপের মুখে পড়েছেন। তিন অভিনেতা এখনও পড়েননি— এই বিষয়টি নিয়েও শাসক শিবিরের অন্দরে অনুযোগ তৈরি হয়েছে, যা চাপা ক্ষোভের আকার নিতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন। এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘অনেক সময়ে এলাকায় ভোটের আগে টিকিট পাওয়ার গোষ্ঠীলড়াই ঠেকাতে দলকে তারকা মুখের উপর ভরসা করতে হয়। কিন্তু আসল হল মমতাদির মুখ।’’ তবে পাশাপাশিই ওই নেতা আরও বলছেন যে, ‘‘তবে সব তারকাই এমন নয়। অনেকে দলীয় অনুশাসন মেনেও চলেন। তবে এই তিন জনকে ব্যতিক্রম বলে ধরে নিলেও তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা উচিত। তা হলে দলের অন্দরে এই বার্তা যাবে যে, নেতা-অভিনেতায় ফারাক নেই। দলের নজরে সকলেই সমান।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy