অতীতে কখনও হোলি, কখনও ছটে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনার সাক্ষী থেকেছে নয়াদিল্লি স্টেশন। গত কাল পদপিষ্টের শিকার হল কুম্ভে যাওয়া ভিড়। গত কাল রাতে আঠারো জনের মৃত্যুর ঘটনা প্রমাণ করে দিল গত দেড় দশক ধরে নয়াদিল্লি স্টেশনে একের পর এক পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটলেও, পরিস্থিতি বদলায়নি বিন্দুমাত্র। উল্টে এ যাত্রায় খোদ রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের বিরুদ্ধে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। রেলমন্ত্রীর ওই অসংবেদনশীল মনোভাবের কারণে তাঁর ইস্তফা দাবি করে সরব হয়েছে কংগ্রেস।
সাত বছর আগে মূল বাজেটের সঙ্গে রেল বাজেট মিশিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। ফলে অতীতে রেল মন্ত্রক যে গুরুত্ব পেত আলাদা বাজেট সংসদে পেশ করার সুযোগ হারানোয় তা ক্রমশ ক্রমশ কমতে শুরু করে। এ যাত্রায় বাজেট বক্তৃতায় রেল সম্পর্কে একটি শব্দ খরচ করতে দেখা যায়নি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে। উপরন্তু এ বছর থেকে রেলের কোন খাতে কত টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে সেই তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, রেলের নিরাপত্তা ও পরিকাঠামো খাতে মূলত বরাদ্দ হওয়া উচিত। কিন্তু তার পরিবর্তে রেলের বাহ্যিক চাকচিক্যে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। নামমাত্র বরাদ্দ হয়েছে ‘কবচ প্রযুক্তি’র মতো খাতে।
রেলে ফি দিন প্রায় আড়াই কোটির কাছাকাছি যাত্রী ট্রেনে চাপেন। বিরোধীদের মতে দেশের আমজনতার নিরাপত্তা যে মন্ত্রকের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে সেই মন্ত্রককে ক্রমশ গুরুত্বহীন করে তুলেছে এই সরকার। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে রেলের জন্য পূর্ণ সময়ের এক জন মন্ত্রী নিয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছেন নরেন্দ্র মোদীরা। কংগ্রেস মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনতের কথায়, ‘‘যিনি দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি আবার রেল চালানোর চেয়ে সমাজমাধ্যমে রিল তৈরি করতে বেশি উৎসাহী। কিন্তু এ বারে যে ভাবে গণহত্যা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে তা মেনে নেওয়া যায় না। অবিলম্বে রেলমন্ত্রীর ইস্তফা দেওয়া উচিত।’’ প্রাক্তন রেলমন্ত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আঠারো জনের মৃত্যু মন ভেঙে দেওয়া খবর। ওই ঘটনা বুঝিয়ে দিচ্ছে নাগরিকদের সুরক্ষার প্রশ্নে যথাযথ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন রয়েছে। যাঁরা কুম্ভে যাচ্ছেন তাঁদের যথাযথ সাহায্য ও পরিষেবার প্রয়োজন রয়েছে... নিশ্চিত করতে হবে তাঁদের সফর যেন নিরাপদ ও সুপরিকল্পিত হয়।’’
গত কালের ঘটনার পরে সার্বিক ভাবে প্রশ্নের মুখে পড়েছে রেলমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রকের ভূমিকা। গত কাল পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা সামনে আসতেই রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব ও তাঁর মন্ত্রক গোড়ায় সেটিকে গুজব বলে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল নেন। সংবাদমাধ্যমকে প্রভাবিত করতে রেল মন্ত্রকের জনসম্পর্ক দফতর থেকে ভিড়হীন নয়াদিল্লি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ছবি, ফাঁকা ট্রেনের ছবি পাঠানো হতে থাকে। দাবি করা হয় পদপিষ্ট হওয়ার কোনও ঘটনা ঘটেনি। গোটাটাই গুজব। রেল থেকে বলা হয় ভিড় বেশি হয়ে যাওয়ায় যাত্রীদের মধ্যে সামান্য ধাক্কাধাক্কি হয়েছিল। রেলপুলিশের তৎপরতায় দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মৃত্যুর কোনও ঘটনা ঘটেনি বলে দীর্ঘক্ষণ দাবি করা হতে থাকে রেলের পক্ষ থেকে। এমনকি রেলমন্ত্রী টুইট করে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনাটিকে গোড়ায় এড়িয়ে যান। তিনি দাবি করেন, সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
কিন্তু ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যে স্টেশনে উপস্থিত যাত্রীদের মোবাইলে তোলা ভিডিয়ো আছড়ে পড়তে থাকে সমাজমাধ্যমে। দুর্ঘটনার এক ঘণ্টা পরে প্রথমে দিল্লির উপরাজ্যপাল বিনয়কুমার সাক্সেনা ও তার কিছু পরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ দুর্ঘটনায় মৃতদের আত্মার শান্তিকামনা করে টুইট করায় দুর্ঘটনা যে হয়নি সেই তত্ত্ব থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয় রেল মন্ত্রক। ওই দুই টুইটের পরে কার্যত সংবাদমাধ্যমে তথ্য পাঠানো বন্ধ করে দেয় রেল। ঘটনার কুড়ি ঘণ্টা পরে আজ সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ প্রথম বার বিবৃতি দিয়ে নয়াদিল্লি স্টেশনে পদপিষ্ট হয়ে মৃত আঠারো জনকে ১৮০ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করে নেয় রেল। পদপিষ্টের ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টার সমালোচনা করে কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরার মন্তব্য, ‘‘রাজার (নরেন্দ্র মোদী) ভাবমূর্তি উজ্জ্বল কী ভাবে থাকবে সেটা নিশ্চিত করাই হল এদের লক্ষ্য। এরা মৃতদের সংখ্যা নিয়ে চিন্তিত নয়। এদের লক্ষ্য হল ভাবমূর্তি সাফ রাখা।’’ কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর কথায় ‘‘এই ঘটনা রেলের ব্যর্থতা ও সরকারের অসংবেদনশীল মনোভাবকেই তুলে ধরেছে।’’ সূত্রের মতে, আজ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা কেন ঘটেছিল এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রুখতে রেল কী করছে তা বিস্তারিত ভাবে জানিয়েছেন অশ্বিনী।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)