দশদ্রোণ এবং বিটি কলেজ। কলকাতায় বিমানের ওঠানামার দু’টি ফানেল পথ। বছরের বিভিন্ন সময়ে ওই দুই এলাকা দিয়ে বিমান কখনও কলকাতায় নামে, কখনও উড়ে যায়। নিয়ম অনুযায়ী, বিমানবন্দরে মসৃণ ভাবে বিমান ওঠানামা করতে রানওয়ের সামনে এবং পিছনে ফানেলের মতো পরিসর ফাঁকা রাখা জরুরি। যাতে কোনাকুনি মাটি ছেড়ে ওঠা বা নামার সময়ে বিমানকে কোনও বাধার সম্মুখীন হতে না হয়। কিন্তু কলকাতা বিমানবন্দরের ফানেল পথ কিংবা তার আশপাশের জায়গায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বহুতল আবাসন-সহ নানা নির্মাণ। সেগুলি কতটা নিরাপদ, আমদাবাদে বিমান দুর্ঘটনার পরে সেই প্রশ্ন নতুন করে উঠতে শুরু করেছে।
দশদ্রোণের দিক থেকে বিমান নামে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং বিটি কলেজের দিক থেকে বিমান নামে মার্চ থেকে অক্টোবর। আবার বিমান ওড়ার সময়টাও ঠিক উল্টো। হাওয়ার গতিপ্রকৃতির উপরে নির্ভর করেই বিমানের ওঠানামার সময়ের এই অদলবদল হয়। ওই দুই জায়গা এবং তার আশপাশের এলাকায় একটি বিমান লোকালয়ের এতটা কাছাকাছি থাকে যে, সেটির বিশাল চেহারা সব চেয়ে কাছ থেকে দেখা যায়। স্থানীয়েরাই জানান, ওই সব তল্লাটে কোনও বাড়ির ছাদে দাঁড়ালে মনে হবে, ঢিল মারলে বিমানের পেটে গিয়ে লাগবে। অনেক সময়ে রাতে ঘুম ভেঙে যায় বিমান ওঠানামার শব্দে। কোনও কোনও বাসিন্দার এমনও দাবি যে, বিমানের হেড লাইটের আলো ফ্ল্যাটের বারান্দায় এসে পড়ে।
এই সব আবাসন কিংবা নির্মাণ বিমানের ওঠানামার ক্ষেত্রে কতটা বিপজ্জনক, তা নিয়ে অনেক দিন ধরে পর্যালোচনা চলছে। বিমানবন্দরের কর্তা জানান, উড়ানের আকার, দৃশ্যমানতা, আপৎকালীন প্রয়োজন-সহ একাধিক কারণে ফানেল পথ পরিচ্ছন্ন থাকা প্রয়োজন। রানওয়ের দু’দিকে অন্তত আধ কিলোমিটার পথ খালি রাখা হয়। দেশের অনেক জায়গাতেই বিমানবন্দর তৈরি হয় শহরের বাইরে। কলকাতা বিমানবন্দরও এক সময়ে তা-ই ছিল। কিন্তু শহর বাড়ায় এখন সেটি জনবসতিতে ঘেরা।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানান, যে উচ্চতা থেকে বিমান রানওয়ের দিকে নামতে শুরু করে, সেটিকে ‘অবস্ট্যাকল ক্লিয়ারেন্স অল্টিচিউড’ বলে। সেটি রানওয়ে সংলগ্ন চার-পাঁচ কিলোমিটার অংশ। তার মধ্যে বিমানবন্দর সংলগ্ন দু’কিলোমিটার অত্যন্ত স্পর্শকাতর।
আমদাবাদের দুর্ঘটনায় বিমানবন্দরের অদূরে মেডিক্যাল পড়ুয়াদের মেসের উপরে বিমানটি ভেঙে পড়ে। ওই ঘটনার পরে ফের প্রশ্ন উঠেছে, কলকাতায় বিমান ওঠানামার জায়গার খুব কাছে থাকা দশদ্রোণ, চিনার পার্ক, মাইকেলনগর, বিটি কলেজ, নিউ টাউনের মতো এলাকায় তৈরি আকাশচুম্বী ইমারতগুলি কতটা নিরাপদ? আবার এই বিপুল জনবসতির কারণে যত্রতত্র তৈরি হওয়া কাঁচা আনাজের বাজার ও রাস্তায় পড়ে থাকা বাজারের বর্জ্য ফানেল পথে পাখির উপদ্রবও বাড়িয়ে তুলছে। চলতি বছর এবং গত বছরে বিমানের সঙ্গে পাখির ধাক্কা লাগার ঘটনা ঘটেছে বলেও বিমানবন্দর সূত্রের খবর।
স্থানীয় পুর সংস্থাগুলির দাবি, ১৪.৫ মিটার পর্যন্ত উচ্চতার নির্মাণকে পুরসভা অনুমোদন দিতে পারে। নির্মাণের উচ্চতা তার বেশি হলে নির্দিষ্ট নির্দেশিকা মেনে পুর বিষয়ক দফতরের অনুমোদন লাগে। আর ফ্লাইং ফানেলের মধ্যে কিংবা আশপাশে নির্মাণের অনুমোদন বিমানবন্দরের অনুমতি সাপেক্ষে দেওয়া হয়।
‘নিউ টাউন কলকাতা ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ (এনকেডিএ)-র এক শীর্ষ আধিকারিকের দাবি, ‘‘ওই সব তল্লাটে বহুতলের অনুমোদন দেওয়া হয় বিমানবন্দর অনুমতি দিলে। তবে মাঝেমধ্যেই ওদের নিয়মের বদল ঘটে। সে সব ক্ষেত্রে নির্মাণের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট আটকে বিমানবন্দরের পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করা হয়।’’ বিধাননগর পুরসভার দাবি, বিমানবন্দরের নির্দেশ মেনে এলাকার খোলা ভ্যাট বন্ধ করা হয়েছে। দমদম পুরসভার দাবি, তাদের এলাকায় খোলা বাজার ঘেরার কাজ শুরু হয়েছে। বিমানবন্দরের লোকজন তা পরিদর্শনও করে গিয়েছেন। উত্তর দমদম পুরসভা জানিয়েছে, বিমানবন্দরের তিন নম্বর গেট থেকে গৌরীপুরের মধ্যে খোলা বাজার ঘিরে পাখির উপদ্রব বন্ধের চেষ্টা হচ্ছে।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, এলাকায় বিভিন্ন নির্মাণ, গাছ, হোর্ডিং ছাড়াও বহুতল বাড়ির বজ্র নিরোধক যন্ত্র কলকাতায় বিমান ওঠানামার ক্ষেত্রে বাধার কারণ হচ্ছে। গাছ, বাতিস্তম্ভ, হোর্ডিং, জলের ট্যাঙ্ক, মোবাইল টাওয়ার মিলে ৩০০টি বাধা চিহ্নিত হয়েছিল। যার ১০০টি সরানো হয়েছে। পাশাপাশি, শতাধিক বাড়িও চিহ্নিত করে ১৫টি ভাঙা হয়েছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)