Advertisement
E-Paper

স্বস্তি মিলতেই একসুর অনুব্রত-দুধকুমার

রাজনীতির ময়দানে ওঁরা দু’জন কিছু দিন আগে পর্যন্তও ছিলেন পরস্পরের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। এক জন এখনও শাসকদলের জেলা সভাপতি। অন্য জন নিজের দলের সভাপতি পদে ইস্তফা দেওয়ার পর থেকে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর ততটা তীব্র নয়।

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৫ ০৩:২৬
গত পঞ্চায়েত ভোটের আগে যে উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেই মামলায় আগামী ৭ জুলাই তাঁকে সিউড়ির সিজেএম আদালতে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে। সেই নির্দেশ পাওয়ার পরে বোলপুরের নিচুপট্টিতে দলের কার্যালয়ে আনন্দবাজারের মুখোমুখি অনুব্রত মণ্ডল।

গত পঞ্চায়েত ভোটের আগে যে উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেই মামলায় আগামী ৭ জুলাই তাঁকে সিউড়ির সিজেএম আদালতে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে। সেই নির্দেশ পাওয়ার পরে বোলপুরের নিচুপট্টিতে দলের কার্যালয়ে আনন্দবাজারের মুখোমুখি অনুব্রত মণ্ডল।

রাজনীতির ময়দানে ওঁরা দু’জন কিছু দিন আগে পর্যন্তও ছিলেন পরস্পরের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। এক জন এখনও শাসকদলের জেলা সভাপতি। অন্য জন নিজের দলের সভাপতি পদে ইস্তফা দেওয়ার পর থেকে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর ততটা তীব্র নয়। দু’জনের বিরুদ্ধেই দু’টি ভোটের আগে উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগ ছিল। শাসকদলের দাপুটে নেতার বিরুদ্ধে পুলিশ দিয়েছিল লঘু ধারা। কিন্তু, একই ‘দোষ’ করে বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে তুলনায় গুরুতর ও জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা করেছিল পুলিশ।

এক জন বীরভূম জেলার তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। অন্য জন, এই সে দিন পর্যন্তও যাঁকে ভাবা হত বীরভূমে অনুব্রতকে সমানে সমানে টক্কর দেওয়ার একমাত্র লোক, সেই বিজেপির প্রাক্তন জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল। বুধবার দু’জনকেই স্বস্তি দিয়ে লঘু ধারা দেখিয়ে চূড়ান্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দিল জেলা পুলিশ। অর্থাৎ, পুলিশের তরফে কার্যত ‘ক্লিনচিট’ পেয়ে গেলেন দুই নেতাই! আদালত দু’জনকেই হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। দু’জনে একই সুরে জানিয়েছেন, তাঁরা আদালতে হাজিরা দেবেন।

২০১৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক মুখে পাড়ুইয়ের কসবায় প্রকাশ্য সভায় পুলিশের উপরে ‘বোম’ মারা এবং নির্দল প্রার্থীদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন অনুব্রত। ওই বক্তৃতার পরেই কসবা অঞ্চলে একাধিক নির্দল প্রার্থীর (বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) বাড়িতে হামলা, বোমাবাজি হয়। নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বৃদ্ধ বাবা সাগরচন্দ্র ঘোষকে বাড়িতেই গুলি করে মারা হয়। অনুব্রত-সহ ৪১ জন তৃণমূল নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন নিহতের পুত্রবধূ।

উস্কানিমূলক বক্তৃতা এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে অনুব্রতর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে লঘু ধারায় মামলা করলেও বীরভূমের তৎকালীন মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) রাজেশ চক্রবর্তী পাড়ুই থানাকে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা করার নির্দেশ দেন। অনুব্রতর বিরুদ্ধে মামলায় পুলিশের যে গাফিলতি রয়েছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে পুলিশ সুপারকে পাঠানো লিখিতে নির্দেশে বিচারক বলেছিলেন, ‘এটি পুলিশের দিক থেকে নিষ্ক্রিয়তা। যা হাল্কা ভাবে নেওয়া উচিত নয়।’ পুলিশ অবশ্য এই দু’বছর জামিন-অযোগ্য সেই সব ধারা আদৌ প্রয়োগ করেনি। তদন্ত চালানোর নামে তারা গোটা মামলাই ধামাচাপা দিতে চাইছে বলে অভিযোগ করে এসেছেন বিরোধীরা। অনুব্রতর ওই বক্তৃতা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতেও তুমুল হইচই হয়েছে। কিন্তু, লাগাতার সমালোচনা ও অনুব্রতকে গ্রেফতারের দাবির মুখেও অনুব্রত ওরফে কেষ্টর পাশে ‘শেষ শক্তি’ পর্যন্ত দাঁড়ানোর বার্তা দিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যুক্তি দিয়েছিলেন, অনুব্রতর মাথায় অক্সিজেন কম যায়। তাই মাঝেমধ্যে তিনি ভুলভাল বলে ফেলেন। মুখ্যমন্ত্রী পাশে থাকায় পুলিশ তৃণমূল সভাপতিকে ধরা তো দূরে থাকা, জিজ্ঞাসাবাদ করার সাহসও দেখায়নি।

দু’বছর ধরে সেই ঘটনার তদন্ত করে এ দিন চূড়ান্ত রিপোর্ট বর্তমান সিজেএম ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়ের এজলাসে জমা দিয়েছে পাড়ুই থানার পুলিশ। আগামী ৭ জুলাই তাঁর এজলাসে অনুব্রতকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সিজেএম। অনুব্রতর কণ্ঠস্বর পরীক্ষার রিপোর্টও আদালতে জমা পড়েছে।

বিজেপির প্রাক্তন জেলা সভাপতি দুধকুমার বরাবরই বলে এসেছেন, বীরভূমে অনুব্রতকে টক্কর দিতে হলে তাঁর ভাষাতেই কথা বলতে হবে। লোকসভা ভোটের আগে রাজনগরে এক কর্মিসভায় দুধকুমার হুমকি দেন, ‘‘ওরা (তৃণমূল) যদি একটা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় তাহলে গোটা পাড়া আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিতে হবে। আমরা সেটা চাই না। তবে ওরা যদি করে, তা হলে আমরা ছেড়ে দিতে রাজি নই।’’ সভায় অনুব্রতর উদ্দেশেও কড়া হুঁশিয়ারি শোনা গিয়েছিল দুধকুমারের গলায়। তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতির অভিযোগের ভিত্তিতে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা শুরু করে রাজনগর থানার পুলিশ। এ দিন তারাও চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়েছে সিউড়ির এসিজেএমের এজলাসে। এবং অনুব্রতর মতোই লঘু ধারা প্রয়োগ হয়েছে এই বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে। এসিজেএম দেবকুমার গোস্বামী দুধকুমারকে আগামী ২৪ অগস্ট তাঁর এজলাসে হাজির হতে বলেছেন।

ঘটনাচক্রে এ দিনই দুধকুমারের বিরুদ্ধে আরও একটি উস্কানিমূলক বক্তৃতার (হাত কেটে নেওয়ার হুমকি) মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট রামপুরহাট আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ। ওই মামলাতেও তাঁকে ১৪ অগস্ট হাজিরার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

এ দিন বিকেলে বোলপুরের নিচুপট্টিতে দলীয় কার্যালয়ে পাওয়া গেল অনুব্রতকে। আদালতের নির্দেশের প্রসঙ্গ তুলতেই জানিয়ে দিলেন, তিনি নির্দিষ্ট দিনেই আদালতে হাজিরা দেবেন। তাঁর কথায়, ‘‘বিচার ব্যবস্থার প্রতি আমার যথেষ্ট আস্থা ও বিশ্বাস আছে। বিচারক নির্দেশ দিয়েছেন। আমি আদালতে হাজির হব। আইন আইনের পথে চলবে। এ নিয়ে আমি আর কী বলব?’’

একই সুরে ময়ূরেশ্বরের কোটাসুরে নিজের বাড়িতে বসে দুধকুমারের প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমি নির্ধারিত দিনেই আদালতে হাজিরা দেব এবং বিচারকের কাছে নিজের মন্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশও করব। আদালতকে জানাব, ভবিষ্যতে আর কখনও এ ধরনের কথা বলব না।’’

ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, তাঁর মন্তব্য ‘প্ররোচনামূলক’ হলে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এবং যুব তৃণমূল সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই ‘অপরাধ’ করেছেন। ‘‘এক যাত্রায় পৃথক ফল হওয়া উচিত নয়’’—বলছেন দুধকুমার। লোকসভা ভোটের ঠিক আগে রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গুচ্ছ অভিযোগ তুলে আচমকাই জেলা সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বসেন দুধকুমার। এখন সে ভাবে দলের কর্মসূচিতে তাঁকে দেখাও যায় না। এ দিন তিনি নিজেও বলেছেন, ‘‘দল থেকে এখন আমি সরে এসেছি!’’

এই পরিপ্রেক্ষিতেই বীরভূমের রাজনীতিতে জোর চর্চা, অনুব্রত এবং দুধকুমার, দুই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হওয়া পুলিশি তদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্ট একই দিনে আদালতে জমা পড়া নিয়ে। এই ঘটনা কি নিছকই সমাপতন, নাকি ‘বিশেষ উদ্দেশ্য’ রয়েছে এর পিছনে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। জেলার পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। এসএমএসের জবাবও মেলেনি। পুলিশ সূত্রের খবর, চূড়ান্ত রিপোর্টে অনুব্রতর বিরুদ্ধে ১৮৯, ৫০৫/১বি এবং ৫০৬ ধারায় মামলা হয়েছে। এই তিনটিই জামিনযোগ্য এবং আদালতের ধর্তব্যযোগ্য নয়। তাৎ‍পর্যপূর্ণ ভাবে, দুধকুমারের বিরুদ্ধে এই ধরনের ধারাই (জামিন-অযোগ্য ধারা আর রইল না) প্রয়োগ করেছে পুলিশ। জেলা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর রণজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘দুই নির্বাচনের আগে ওই দুই নেতা প্ররোচনামূলক বক্তব্য পেশ করেছিলেন। সেই বক্তব্য পেশের জন্য কারও নির্দিষ্ট করে ক্ষতি হয়েছে, এমন প্রমাণ পুলিশি তদন্তে মেলেনি। সে জন্যই পুলিশ এই ধারাগুলি দিয়েছে।’’

এ কথা শুনে হৃদয় ঘোষ ক্ষোভের সুরে বলছেন, ‘‘অনুব্রতর ওই বক্তৃতার পরেই আমি আমার বাবাকে হারালাম। আর সরকারি আইনজীবী বলে দিলেন, কারও কোনও ক্ষতি হয়নি! আসলে সব কিছুর মূলে রয়েছে পুলিশ!’’ বিরোধীরা আবার প্রশ্ন তুলছেন, অনুব্রতর বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দু’বছর লাগল। আর দুধকুমারের ক্ষেত্রে একই রকম অভিযোগের তদন্ত বছর ঘুরতেই শেষ? জেলার এক সিপিএম নেতার কটাক্ষ, ‘‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়!’’

Dudh Kumar Mandal Anubrata Mondal Bolpur Birbhum BJP Trinamool
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy