Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Narayan Debnath

Narayan Debnath: হাফ প্যান্ট পরা বয়সে ফিরতে গেলে বাঙালির তিনি ছাড়া গতি নেই

নারায়ণ দেবনাথ কি কেবল একটা ব্যক্তিনাম? ১৯৬০-এর দশক থেকে বাঙালি সংস্কৃতির একটা প্রত্যঙ্গই হয়ে গিয়েছে বোধ হয় ওই নামটা।

বাংলা চিত্রকাহিনি বা কমিকসের প্রাণপুরুষ নারায়ণ দেবনাথের জীবনাবসান। ছবি: শান্তনু ঘোষ।

বাংলা চিত্রকাহিনি বা কমিকসের প্রাণপুরুষ নারায়ণ দেবনাথের জীবনাবসান। ছবি: শান্তনু ঘোষ।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২২ ১১:১৭
Share: Save:

‘বুকের পাটাওয়ালা লোক’ বলতে গেলেই যে ছবিটা সবচেয়ে আগে বাঙালির মানসপটে ভেসে ওঠে, সেটা বাঁটুল দি গ্রেটের।

সারাজীবন হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা বাঁটুলের বয়স কত? সে যুবক না কিশোর? এ সব প্রশ্ন বাঙালি কোনও দিন মনেও আনেনি। ‘শুকতারা’ হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মলাট উলটে চলে গিয়েছে প্রথম পাতায় ফ্যাকাশে লাল আর কালো রঙে আঁকা সেই জগতে, যেখানে দুই ওস্তাদের সঙ্গে ক্রমাগত টক্কর দিয়ে চলেছে এক বিরাটবক্ষ বীর। ‘বাঁটুল দি গ্রেট’। বাঙালি কোনও দিন মনেও আনেনি, যে ওস্তাদদ্বয় ইস্কুল পালায়, তারাই আবার ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে, তারাই কিনা মহাবলী বাঁটুলকে জব্দ করার ফন্দি আঁটে। বাঁটুলের মতো তাদেরও পরনে হাফ পেন্টুল। ১৯৬৫ সাল থেকে এখনও তারা ওই হাফপ্যান্টেই আটকে রয়েছে। সেই কারণেই বোধ হয় নিজেদের হাফপ্যান্ট পরা বয়সে ফিরতে গেলে প্রৌঢ় বা প্রায় বৃদ্ধ বাঙালি অনায়াসে ঢুকে পড়তে পারেন সেই ফ্যাকাশে লাল আর কালো রঙের দুনিয়ায়।

যে দুনিয়ার একমেবাদ্বিতীয়ম স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথ।

নারায়ণ দেবনাথ কি কেবল একটা ব্যক্তিনাম?

নারায়ণ দেবনাথ কি কেবল একটা ব্যক্তিনাম?

নারায়ণ দেবনাথ কি কেবল একটা ব্যক্তিনাম? ১৯৬০-এর দশক থেকে বাঙালি সংস্কৃতির একটা প্রত্যঙ্গই হয়ে গিয়েছে নামটি। ১৯৬২ সালে ‘হাঁদা-ভোঁদা’, ১৯৬৫-তে ‘বাঁটুল দি গ্রেট’, ১৯৬৯-এ ‘নন্টে-ফন্টে’ বাঙালির শৈশব এবং কৈশোরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কমিক স্ট্রিপ। সেই সঙ্গে এরাই হল দমচাপা বড়বেলা থেকে পালিয়ে যাওয়ার শুঁড়িপথ। বাঙালির সুপারহিরো ছিল না। কিন্তু কোথাও একটা বীরভাব ছাইচাপা আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলত। বাঁটুল দি গ্রেট সেটারই মূর্ত রূপ। মনে রাখতে হবে, ১৯৬২তে ঘটে গিয়েছে ভারত-চিন যুদ্ধ, ১৯৬৫-এও ভারত-পাকিস্তান যুযুধান। বাঁটুলের আগমন কি সেই যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে কোথাও জাতীয়তাবোধের জাগরণকে চিহ্নিত করে? ভারত-পাক সঙ্ঘাতের সময়ে খানসেনাদের ‘প্যাটন পেটা’ করে বাঙালির (পরে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের সময়েও) একান্ত জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরেছিল বাঁটুল। সে কথা কে ভুলবে!

নারায়ণ দেবনাথ বাংলা কমিক্স সাহিত্যের প্রথম পর্বের অন্যতম দিশারী। বাঁটুল দি গ্রেটের স্ট্রিপে চোখ রাখলে বোঝা যায়, এর কুশীলবরা এক অলীক নগরীর বাসিন্দা। সেই ভুবনে কেমন যেন একটা কাউবয় অধ্যুষিত আমেরিকান ওয়েস্টের গন্ধ। তবে সেখানে হিউমার সৃষ্টি হয় একেবারেই বাঙালি কেতায়। ভুঁইফোঁড়, লোক-ঠকানো, ফ্যাশন-সর্বস্ব পোশাকের দোকানের নাম ‘অঙ্গবাহার’ আর সাদাসিধে পোশাক বিপণির নাম ‘অঙ্গঢাকা’— এমন রসবোধে মজে যেতে সময় লাগেনি বাঙালি পাঠকদের। তবে ‘হাঁদা-ভোঁদা’র পরিমণ্ডল কিন্তু ষোল আনা বাঙালি। রোগা-পাতলা হাঁদা তার চালাকি নিয়ে নাজেহাল হবেই আর সহজ-সরল মোটাসোটা ভোঁদা জিতবে শেষমেশ— এই কাঠামো বার বার পুনরাবৃত্ত হলেও একটুও একঘেয়ে লাগেনি। কারণ একটাই— এই কমিক স্ট্রিপ খুদে দস্যিদের একাত্ম বোধ করাতে পেরেছিল। তাদের অভিভাবকদের ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অমল কৈশোরে।

তবে তুলনায় ‘নন্টে-ফন্টে’র দুনিয়া একেবারেই আলাদা। ছাত্রাবাসের ঘেরাটোপে সুপারিন্টেন্ডেন্ট পাতিরাম হাতি (নাকি হাতিরাম পাতি?) আর বেয়াদপ সিনিয়র কেল্টুর সঙ্গে নন্টে-ফন্টের অনিঃশেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হস্টেল জীবন কাটিয়ে আসা বঙ্গসন্তানকে এখনও স্মৃতিভারাক্রান্ত করে। যাঁরা সেই জীবনের স্বাদ পাননি, বন্ধুদের মুখ থেকে শুনেছেন সেই জীবনের নানা কাহিনি, তাঁদেরও প্রায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্বাদ দিতে সমর্থ এই চিত্র-কাহিনি।

তবে এর পাশাপাশি আরও বেশ কিছু কমিক স্ট্রিপ রচনা করেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। ‘বাহাদুর বেড়াল’, ‘ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু’, ‘ডিটেকটিভ কৌশিক রায়’ ইত্যাদি। তবে এ সবের মধ্যে উল্লেখের দাবি রাখে ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়’ সিরিজ। দুর্দান্ত অপরাধী ব্ল্যাক ডায়মন্ড আর গোয়েন্দা ইন্দ্রজিতের টক্করে কে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়, তা জানা যায় না কখনওই। ১৯৮০-১৯৯০-র দশকে সেই সব চিত্রকাহিনি গোগ্রাসে গেলেনি, সেই সময়ে কৈশোর পেরোতে থাকা তেমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

বাংলা কমিক্স সাহিত্যের প্রথম পর্বের অন্যতম দিশারী নারায়ণ দেবনাথ।

বাংলা কমিক্স সাহিত্যের প্রথম পর্বের অন্যতম দিশারী নারায়ণ দেবনাথ।

শুধু কমিক স্ট্রিপের রচয়িতা হিসেবে নয়, বাংলা গ্রন্থচিত্রণের অন্যতম প্রধান মুখ ছিলেন নারায়ণ দেবনাথই। দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রকাশিত পূজাবার্ষিকীতে বিমল দাস, তুষার কান্তি চট্টোপাধ্যায়, শৈল চক্রবর্তীর পাশাপাশি বিরাজ করতেন নারায়ণ দেবনাথ। অন্যদের তুলনায় তাঁর অলঙ্করণের ক্ষেত্রটা ছিল একটু আলাদা। বিমল দাস বা শৈল চক্রবর্তী যেখানে হাসির গল্পের জন্য কার্টুনধর্মী ছবি আঁকতেন, নারায়ণ দেবনাথের ভাগে পড়ত রহস্য-রোমাঞ্চ বা ভয়ের গল্প। রিয়্যালিস্টিক ঘরানার সেই সব অলঙ্করণ কাহিনিকে একেবারে পাঠকের মগজে সেঁধিয়ে ছাড়ত। অনেক বছর পরে গল্পের নাম ভুলে গেলেও অলঙ্করণের দৌলতে তাদের এখনও মনে করতে পারেন সে দিনের বইপোকারা। হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের কলম থেকে নির্গত ভূতের গল্প আর তার সঙ্গে নারায়ণ দেবনাথের কালি-কলমে আঁকা সাদা-কালো ভয়ের জগৎকে কী করে ভুলবে পুজোর ছুটির দুপুরে ‘উদয়ন’, ‘তপোবন’ পড়া বাঙালি!

তার পরে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে বাংলা শিশুসাহিত্য। কমিক স্ট্রিপ হিসেবে বাঙালি পাঠকের মনে জায়গা করে নিয়েছে আন্তর্জাতিক টিনটিন, অ্যাস্টারিক্স। বলীয়ান নায়ক হিসেবে দাপিয়ে বেড়িয়েছে ব্যাটম্যান, সুপারম্যান। কিন্তু তাতে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা বা নন্টে-ফন্টের কিছু এসে যায়নি। এখনও কলকাতা বইমেলায় হ্যারি পটার কেনার পর বাঁটুলের কাট-আউট লাগানো স্টলে লাইন দিতে দেখা যায় অগণিত খুদেকে। পাশাপাশি তাদের বাবা-মা’কেও। প্রফেসর ক্যালকুলাসের সঙ্গে, প্রফেসর ডাম্বলডোরের সঙ্গে কেমন সহজ সহাবস্থানে থেকে যান সুপারিন্টেন্ডেন্ট পাতিরাম হাতি। টিনটিন সহজেই বন্ধুত্ব করে নেয় নন্টে বা ভোঁদার সঙ্গে। বাঁটুলকে তার ব্যাটমোবাইলে নিয়ে ঘোরে ব্যাটম্যান। কোথাও কোনও বিরোধ নেই। সহজ একটা অবস্থান। এমনটা বোধ হয় বাংলাতেই সম্ভব।

আর তা সম্ভব হয়েছিল নারায়ণ দেবনাথের মতো এক বহুমুখী চিত্রকাহিনিকার এখানে জন্মেছিলেন বলে। সাদা-কালোয় বা দুই রঙে আঁকা সেই সব অসংখ্য ছবি আর কমিক্স এখনও বাঙালির জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। হাফপ্যান্ট পরা বয়সে ফিরে যাওয়া যায় স্রেফ তাদের পাতা ওল্টালেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Narayan Debnath Bengali Cartoonist Death Obituary
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE