Advertisement
০৭ মে ২০২৪

সুভাষকে ভুলেছে লালগড়

ব্রিটিশ সরকারের কড়া নজরদারি আর স্থানীয় বর্ধিষ্ণুদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় জঙ্গলমহলে স্বরাজ আন্দোলনের ঢেউ বড়ই নিস্তরঙ্গ।

ফিরে-দেখা: ঝাড়গ্রামের দহিজুড়িতে সুভাষচন্দ্র। তাঁর পাশে টুপি পরে কুমার দেবেন্দ্রলাল খান। ছবিটি ১৯৪০ সালের ১২ মে সকাল দশটায় তোলা। ওই দিন ধেড়ুয়া হয়ে ঝাড়গ্রাম আসার পথে দহিজুড়িতে সুভাষচন্দ্রকে স্বাগত জানিয়েছিলেন স্থানীয়রা। (ছবি: গবেষক তারাপদ করের সৌজন্যে পাওয়া)

ফিরে-দেখা: ঝাড়গ্রামের দহিজুড়িতে সুভাষচন্দ্র। তাঁর পাশে টুপি পরে কুমার দেবেন্দ্রলাল খান। ছবিটি ১৯৪০ সালের ১২ মে সকাল দশটায় তোলা। ওই দিন ধেড়ুয়া হয়ে ঝাড়গ্রাম আসার পথে দহিজুড়িতে সুভাষচন্দ্রকে স্বাগত জানিয়েছিলেন স্থানীয়রা। (ছবি: গবেষক তারাপদ করের সৌজন্যে পাওয়া)

কিংশুক গুপ্ত
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:৫০
Share: Save:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে তখন। চল্লিশের শতকের শুরুতে জাতীয় রাজনীতিতে সে এক উথাল-পাথাল সময়। লালমাটি আর সবুজ শাল গাছে ঘেরা ঝাড়গ্রামের রাজপরিবার কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। একদিকে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর সত্যাগ্রহ। অন্য দিকে সুভাষচন্দ্রের স্বরাজের ডাক। দুই দেশনেতার মধ্যে মতবিরোধ। কংগ্রেসের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের দূরত্ব তখন স্পষ্ট। তখনও তিনি নেতাজি হননি। ব্রিটিশ সরকারের কড়া নজরদারি আর স্থানীয় বর্ধিষ্ণুদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় জঙ্গলমহলে স্বরাজ আন্দোলনের ঢেউ বড়ই নিস্তরঙ্গ।

বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্কে পূর্ববঙ্গ ও কলকাতা থেকে আসা দলে দলে লোকজন বসতি গড়ে তুলছেন অরণ্যমহলে। কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশনের তখন প্রধান শিক্ষক ছিলেন রাধাশ্যাম বসু। স্কটিশচার্চ কলেজে সুভাষচন্দ্রের সমসাময়িক সহপাঠী হিসেবে পরিচিত রাধাশ্যামবাবু হঠাৎ ক্লাসে-ক্লাসে একটি নোটিস পাঠালেন। শেষ বৈশাখের দগ্ধ দিনে সেই নোটিস পেয়ে কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্র ক্ষোভে ফুঁসতে থাকলেন। ক্ষোভ ছড়াল একাংশ অভিভাবক মহলেও। নোটিসের বয়ান, ‘যাহারা লালগড় মাঠে সভা শুনিতে যাইবে, সেই সকল ছাত্রদিগকে বিদ্যালয় হইতে বহিষ্কার করা হইবে।’ স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বিষয়টি জেনে ভীষণই ক্ষুব্ধ হলেন।

১২ মে ১৯৪০ ঝাড়গ্রামের লালগড় মাঠে (এখনকার দুর্গা ময়দান) স্বরাজের আহ্বান-সভার আয়োজন করেছিলেন নাড়াজোলের কুমার দেবেন্দ্রলাল খান। আর রাধাশ্যাম বসু হেড মাস্টার হয়ে স্বরাজের বিরোধিতা করছেন জেনে বেজায় চটলেন সুভাষচন্দ্র! সুভাষচন্দ্র ঠিক করলেন, প্রকাশ্য সভায় বিষয়টি উত্থাপন করে রাধাশ্যামবাবুকে একহাত নেবেন। ঝাড়গ্রামের ওই সভাটিই ছিল অবিভক্ত মেদিনীপুরে সুভাষচন্দ্রের শেষ জনসভা। ১৯৪০ সালের ১২ মে সুভাষচন্দ্রের ওই সভার বিস্তারিত সংবাদটি একদিন পরে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯৪০ সালের ১৪ মে আনন্দবাজারে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের তীব্র মতবিরোধ সত্ত্বেও ওই দিন ঝাড়গ্রামে কংগ্রেস কর্মীরাই তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন কৃষক ও যুবকেরা। ঝাড়গ্রামে ব্যবসায়ী নলিনবিহারী মল্লিকের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করে একটি টালির বাড়িতে (এখন এটি বাছুরডোবা পেট্রল পাম্পের অফিস ঘর) বিশ্রাম নেন সুভাষচন্দ্র। দুপুরে নতুনডিহিতে কর্মী সম্মেলন করেন। তারপর বার-লাইব্রেরিতে (বর্তমান ঝাড়গ্রাম বার অ্যাসোসিয়েশনের আদি ভবন) আইজীবীদের সঙ্গে মিলিত হন। বিকেলে লালগড় মাঠে (দুর্গা ময়দান) জনসভায় বক্তব্য রাখেন। ওই সভার উদ্যোক্তা ছিলেন নাড়াজোল রাজ এস্টেটের কুমার দেবেন্দ্রলাল খান।

১৯৪০ সালের ১৪ মে আনন্দবাজারে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, প্রকাশ্য জনসভায় প্রধান শিক্ষক রাধাশ্যাম বসুর সমালোচনা করে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, “দুঃখ ও লজ্জা হয় এই জন্য যে, এই রকম মানুষ এখনও আছে। তাঁহারা আবার ছেলেদের শিক্ষার ভার গ্রহণ করিয়াছেন। স্বরাজ হইলে প্রথমেই এই সকল শিক্ষকদের শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে, তারপর ছাত্রদের ব্যবস্থা হইবে।” শোনা যায়, পরে নিজের কৃতকর্মের জন্য ঘনিষ্ঠমহলে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন রাধাশ্যামবাবু। ইংরেজ প্রশাসন ও স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের চাপে পড়ে প্রধানশিক্ষককে ওই কাজ করতে হয়েছিল প্রধানশিক্ষককে। তবে সুভাষচন্দ্রের কাছে আর দুঃখপ্রকাশ করার সুযোগ পাননি তিনি। অথচ সুভাষচন্দ্রের ঝাড়গ্রামে পদার্পণের দিনটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য আজ পর্যন্ত প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এই অরণ্য শহরে সুভাষচন্দ্র জনসভা করেছিলেন, সেই তথ্য অনেকেরই অজানা। এখন যেটি দুর্গা ময়দান, বহু আগে সেটি লালগড় রাজাদের হেফাজতে থাকায় নাম ছিল লালগড়ের মাঠ। শোনা যায়, সুভাষচন্দ্রের সভার জন্য ঝাড়গ্রামে অন্য কোনও মাঠ পাওয়া যায়নি। সেই কারণে লালগড়ের মাঠে সভাটি হয়।

ঝাড়গ্রাম শহরের যেখানে সুভাষচন্দ্র সভা করেছিলেন, সেই ঐতিহাসিক ‘লালগড়ের মাঠ’টির বর্তমান নাম দুর্গা ময়দান। আয়তন কমে মাঠের আর কোনও অস্তিত্ব নেই। শহরের প্রাচীনতম দুর্গা ময়দান সর্বজনীন দুর্গোত্সব কমিটির স্থায়ী দুর্গামন্দির তৈরি হয়েছে। ১৯৯৭ সালে সুভাষচন্দ্রের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বেসরকারি ভাবে দুর্গা ময়দান রক্ষা কমিটির উদ্যোগে মাঠের একপাশে একটি স্মারকস্তম্ভ তৈরি করা হয়। স্মারক স্তম্ভটির উদ্বোধন করেছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বর্তমানে প্রয়াত সুবোধচন্দ্র হাঁসদা। কিন্তু ওই স্মৃতিস্তম্ভের ফলকটিতে ভুল তথ্য লেখা রয়েছে। ফলকে লেখা আছে, পরাধীন ভারতবর্ষে সুভাষচন্দ্রের শেষ জনসভাটি দুর্গা ময়দানে হয়েছিল।

সুভাষচন্দ্রের জনসভা নিয়ে গবেষণারত প্রবীণ সাংবাদিক তারাপদ কর জানালেন, ঝাড়গ্রামের সভাটি ভারতবর্ষে সুভাষচন্দ্রের শেষ জনসভা নয়। ১৯৪০ সালের মে মাসে আরও ৮টি সভা করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। ১৯৪০ সালের ঢাকার করোনেশন পার্কের সভাটি সম্ভবত সুভাষচন্দ্রের শেষ জনসভা। এরপর ১৯৪০ সালের ২ জুলাই দুপুরে ব্রিটিশ পুলিশ এলগিন রোডের বাড়ি থেকে সুভাষচন্দ্রকে ভারতরক্ষা আইনে গ্রেফতার করে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে গিয়েছিল। তবে ১৯৪০ সালে ১২ মে ঝাড়গ্রামের জনসভাটি অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় সুভাষচন্দ্রের শেষ জনসভা ছিল। তারাপদবাবুর আক্ষেপ, “প্রশাসনিক ভাবে আজ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্রের ঝাড়গ্রামে আগমনের বিষয়টিকে কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সিংহভাগ ঝাড়গ্রামবাসী সুভাষচন্দ্রের ওই জনসভার দিনটি সম্পর্কে জানেন না। এটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয়।” তারাপদবাবুর নিরলস গবেষণা করেছেন সুভাষচন্দ্রের ঝাড়গ্রামের সভাটি নিয়ে।

সুভাষচন্দ্রের ওই সভার শ্রোতা বর্তমানে প্রয়াত অশীতিপর বৃদ্ধ সুধাকর মাহাতো বছর দু’য়েক আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় এক স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন, ওই দিন বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ সভাস্থলে পৌঁছেছিলেন সুভাষচন্দ্র। পরণে ধুতি-পাঞ্জাবি। মাথায় গাঁধী টুপি। তিনি মাঠে পৌঁছতেই আতসবাজি পুড়িয়ে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়। মহিলারা গেয়ে ওঠেন, ‘দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী’। সব কথার মানে বোঝেননি সুধাকরবাবু। তবে সভায় যাওয়ার খবর চলে গিয়েছিল প্রধান শিক্ষকের কাছে। স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরে অপমানে আর স্কুলের চৌকাঠ মাড়াননি সুধাকরবাবু। সুধাকরবাবুর লেখা থেকে জানা যায়, সভা শেষে সুভাষচন্দ্র ঝাড়গ্রাম স্টেশন থেকে রাতের ট্রেনে ফিরে গিয়েছিলেন। সেদিন তাঁকে দেখতে মানুষের ঢল নেমেছিল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE