গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বাঙালির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অভিধানগুলির একটিতে বাংলা বর্ণমালাতেই ত্রুটি রয়ে গিয়েছে! বছরের পর বছর ধরে থেকে যাওয়া ওই ত্রুটি আনন্দবাজার অনলাইনের নজরে আসতেই অভিধানের প্রকাশক সংস্থা ‘সাহিত্য সংসদ’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু এক মাসের বেশি নানা ভাবে নানা জনকে যোগাযোগ করেও তাঁদের কোনও মতামত বা প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তবে শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত যাঁর সঙ্গেই আনন্দবাজার অনলাইন এ নিয়ে কথা বলেছে, তাঁরা প্রত্যেকেই এই ত্রুটি সংশোধন জরুরি বলে মনে করেছেন।
ত্রুটিটি রয়েছে ‘সংসদ বাংলা অভিধান’-এ। যার বয়স প্রায় ৬৭ বছর। ১৯৫৭ সালের নভেম্বরে এর প্রথম প্রকাশ। ১৯৭১ সালে তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। সেই তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা পঞ্চম এবং সর্বশেষ সংস্করণেও (নভেম্বর, ২০০০) সঙ্গত ভাবেই ছাপা হয়েছিল। কারণ, এই অভিধানের সংকলন, সংশোধন এবং পরিবর্ধন করতে গিয়ে কী কী নীতি বা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, তা সেখানে উল্লেখ করেছিলেন সংকলক শৈলেন্দ্র বিশ্বাস। পঞ্চম সংস্করণ ১৯ বার পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত। এই ভূমিকায় রয়েছে বর্ণানুক্রম বিধিও।
কিন্তু যে বর্ণানুক্রম রয়েছে, তাতে ‘ঢ’ নেই। দু’বার রয়েছে ‘ড’। নিঃসন্দেহে এটি ‘অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি’। কিন্তু ত্রুটি। যা সকলেরই নজর এড়িয়ে গিয়েছে বছরের পর বছর। এখানে উল্লেখ্য, বিদ্যাসাগর (ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা) প্রণীত ‘বর্ণপরিচয়’ বইয়ে বাংলার বর্ণানুক্রমের সঙ্গে অভিধানের বর্ণানুক্রমের কিছু ফারাক রয়েছে। তার যুক্তিও রয়েছে সংকলক বা সংকলকদের তরফে। কিন্তু সেই বর্ণানুক্রম লিখতে গিয়ে ‘ঢ’ বর্ণ বাদ পড়ে গিয়েছে। তার বদলে ‘ড’ বর্ণের পুনরাবৃত্তি হয়ে গিয়েছে।
এই ত্রুটি নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে সাহিত্য সংসদের দফতরে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়। কিন্তু কোনও আধিকারিকের প্রতিক্রিয়া মেলেনি। বহু বার সংসদের দফতরে ফোন করা হয়েছিল। খোঁজ করা হয়েছিল প্রকাশক দেবজ্যোতি দত্তের। খোঁজ করা হয়েছিল অন্যতম কর্ণধার অন্তরা দত্তেরও। কিন্তু তাঁদের পাওয়া যায়নি। কখনও ফোন ধরে বলা হয়েছে, ‘‘উনি ব্যস্ত রয়েছেন।’’ কখনও, ‘‘ধরুন, দেখছি।’’ মিনিটখানেক অপেক্ষা করানোর পর ওপারের কণ্ঠ বলেছে, ‘‘উনি এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন।’’ কখন পাওয়া যাবে? কখনওই সে ব্যাপারে সদুত্তর মেলেনি। অবশেষে বুধবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আগের দিন, মঙ্গলবার সংস্থার অন্যতম কর্ণধার পীতম সেনগুপ্তের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করলে তিনি কথা বলেন। তিনি হোয়াট্সঅ্যাপে অভিধানের সংশ্লিষ্ট পাতাটির ছবি চান। তা তাঁকে পাঠানোও হয়। কিন্তু তিনি কোনও জবাব দেননি। আবার ফোন করলে তিনি বলেন, ‘‘দফতরে যোগাযোগ করুন। আমি এখন বিমান ধরার তাড়ায় আছি। বিদেশ যাচ্ছি।’’ পীতমের পরামর্শ মেনে মঙ্গলবারও বারংবার ফোন করা হয় সংসদ দফতরে। ফের সেই একই কথা শুনতে হয়। এক বার এক আধিকারিক এ-ও বলেন, ‘‘এ সব ব্যাপারে পীতমবাবুই ভাল বলতে পারবেন।’’ সংসদের শিয়ালদহ দফতরের ফোনে চেষ্টা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি।
সংসদের মতামত না-পাওয়া গেলেও বাংলা ভাষাচর্চার সঙ্গে নানা ভাবে জড়িত কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলেছে আনন্দবাজার অনলাইন। কবি তথা সাহিত্যিক সুবোধ সরকার এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘বর্ণানুক্রমে ‘ঢ’ না থাকাটা বিভ্রান্তিমূলক তো বটেই। অভিধানের ভিতরে ‘ঢ’-এর বর্ণমালা পেয়ে যাই বলেই আমরা অনেকেই হয়তো কিছু বলি না। তবে আমার মনে হয়, পরবর্তী সংস্করণ থেকে বিষয়টি সংশোধন করা উচিত।’’ রাজ্য সরকারের সিলেবাস কমিটির উপদেষ্টা তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অভীক মজুমদার অবশ্য বিষয়টিকে ‘গুরুতর’ বলে কিছু মনে করেন না। তাঁর মতে, এটি নিছকই ‘ছাপার ভুল’। তাঁর বক্তব্য, ‘‘অনেকেই ভূমিকা পড়েন না। পড়লেও তাঁরা বিষয়টিকে ছাপার ভুল হিসাবে দেখেন। তবে আপনারা যে প্রশ্ন তুলেছেন, সেটি যথাযথ। আমার মনে হয়, পরবর্তী সংস্করণে এটি সংশোধন করা উচিত।’’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার বিভাগীয় প্রধান জয়দীপ ঘোষ বলেন, ‘‘ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই বিচিত্র লাগছে! ‘ঢ’ হল বাংলা বর্ণমালায় ‘ড’-এর মহাপ্রাণিত ধ্বনি। সেটা থাকতেই হবে। বছরের পর বছর যদি একই ভুল ছাপা হয়ে থাকে তা খুবই অস্বস্তিকর।’’
‘অস্বস্তি’ কবে কাটবে? সংসদের উত্তরের অপেক্ষায় আনন্দবাজার অনলাইন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy