Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Education

বাজারের পাঠশালা

২০০৫ সাল থেকে শুরু করে ‘অসর’ রিপোর্ট প্রতি বছর প্রকাশ করে একটি অসরকারি সংস্থা। গোড়ায় তা প্রধানত বনিয়াদি শিক্ষা, অর্থাৎ প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের অর্জিত দক্ষতার মূল্যায়ন করত।

students

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

অশোক সরকার
শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:০৬
Share: Save:

পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি হতে চলেছে ভারত। তাতে ক’টা শূন্য? কত ছেলেমেয়ে এর উত্তর দিতে পারত জানি না, কিন্তু দেশের স্কুলশিক্ষা নিয়ে সর্বশেষ ‘অসর’ (অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট, ২০২৩) রিপোর্টে দেখছি, গ্রামীণ এলাকায় ১৪-১৮ বছরের ছেলেমেয়েদের পঁচিশ শতাংশ দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্য থেকে মাতৃভাষায় লেখা বাক্য পড়তে পারছে না, চুয়ান্ন শতাংশ ছেলেমেয়ে তিন অঙ্কের সংখ্যাকে এক অঙ্কের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করতে পারছে না, তেতাল্লিশ শতাংশ একটা অতি সরল ইংরেজি বাক্য পড়তে পারছে না। শুধু তা-ই নয়, পেনসিলের দৈর্ঘ্য কত ইঞ্চি, স্কেলের শূন্য থেকে ধরলে বলতে পারছে, কিন্তু স্কেলের এক বা দুই ইঞ্চির দাগ থেকে ধরলে দশ জনে ছ’জনই তা আর বলতে পারছে না। ‘রাতে মা এগারোটায় শুয়েছে আর ভোর পাঁচটায় উঠেছে, তা হলে কত ঘণ্টা ঘুমোল?’— তা-ও বলতে পারেনি অর্ধেকের বেশি পড়ুয়া। এমনকি একটা জিনিসের দামে দশ শতাংশ ছাড় থাকলে তার দাম কত, তা-ও বলতে পারছে না প্রায় চল্লিশ শতাংশ। না পারার তালিকা বেশ লম্বা, যথেষ্ট উদ্বেগজনক।

সেই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের স্থানটি আরও উদ্বেগ জাগায়। যেমন মাতৃভাষায় দ্বিতীয় শ্রেণির বাক্য পড়তে না পারায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান তৃতীয়, তার নীচে রয়েছে আর মাত্র দু’টি রাজ্য। ইংরেজি বাক্য পড়তে না পারায় এই রাজ্য সবচেয়ে নীচে, সময় গুনতে না পারায় চতুর্থ স্থানে। কেবল ছাড়ের হিসাবের পর জিনিসের দাম নির্ধারণে এ রাজ্য দেশের মাঝামাঝি, বারো নম্বর স্থানে।

তা হলে এই ১৪-১৮ বছরের ছেলেমেয়েরা কী পারে? তারা স্মার্টফোন চালাতে জানে, ইউটিউবে ভিডিয়ো দেখতে, শেয়ার করতে, ইন্টারনেটে তথ্য বা বিনোদন খুঁজতে জানে, সমাজমাধ্যম ব্যবহার করতে জানে, অনেকে গুগল ম্যাপও ব্যবহার করতে জানে। ৮৯ ভাগ ছেলেমেয়ের বাড়িতে অন্তত একটা স্মার্টফোন আছে, যদিও মোবাইল মালিকানায় ও নিজস্ব ইমেল ঠিকানার ব্যাপারে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় অনেকটাই বঞ্চিত।

২০০৫ সাল থেকে শুরু করে ‘অসর’ রিপোর্ট প্রতি বছর প্রকাশ করে একটি অসরকারি সংস্থা। গোড়ায় তা প্রধানত বনিয়াদি শিক্ষা, অর্থাৎ প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের অর্জিত দক্ষতার মূল্যায়ন করত। ২০১৭ সাল, ও তার পরে ২০২৩ সালে ১৪-১৮ বছর, অর্থাৎ অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছেলেমেয়েদের শিক্ষার মূল্যায়ন করছে। সে দিক থেকে এই রিপোর্টটি খুবই প্রাসঙ্গিক। রিপোর্টে এ-ও দেখা যাচ্ছে যে, এই বয়সের ছেলেমেয়েদের একটা বড় অংশের কোনও কিছু হওয়ার স্বপ্ন নেই। যাদের আছে, তারাও পুলিশ, স্কুলশিক্ষক আর ডাক্তার ছাড়া অন্য কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখছে না।

রিপোর্ট এক দিকে যেমন সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার প্রভূত ব্যর্থতার কথা বলছে, তেমনই দেখাচ্ছে যে, বাজারব্যবস্থা কী ভাবে গ্রামীণ এলাকার ঘরে ঘরে পৌঁছেছে। এই ‘বাজারের পাঠশালা’ কতটা সার্থক তাও দেখাচ্ছে। এই ছেলেমেয়েরা যদি স্মার্টফোনের মতো জটিল যন্ত্র চালাতে জানে, তা দিয়ে তার ইচ্ছামতো তথ্য বা বিনোদন আহরণ করতে পারে, তা হলে তারা শিক্ষার অযোগ্য মোটেই নয়। বরং শিক্ষাব্যবস্থাটা তাদের অযোগ্য, এটাই প্রমাণ হয়।

আপত্তি ওঠে, এই ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনতে জামা-প্যান্ট, জুতো-মোজা, বই-খাতা, সাইকেল, কিছু দিতে তো বাকি রাখা হয়নি। একটু তলিয়ে দেখলে দেখব, এ সব দেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু স্কুলে শিক্ষক দেওয়া হয় না। এই মুহূর্তে দেশে দশ লক্ষ শিক্ষকের পদ খালি আছে। তা ছাড়া আরও প্রায় পাঁচ লক্ষ পদে রয়েছেন পার্শ্বশিক্ষকরা। দেশের প্রায় অর্ধেক মাধ্যমিক স্কুলে বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরি নেই। উচ্চ মাধ্যমিকে তা আরও কম। পঠনপাঠন ও শিক্ষাপদ্ধতি বিষয়ে দক্ষ শিক্ষক তৈরির জন্য যে প্রশিক্ষণের পরিকাঠামো প্রয়োজন, তা নেই। দেশের ৮৬ শতাংশ বিএড কলেজই বেসরকারি, এবং সেগুলির গুণমান নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন ওঠে। ধারাবাহিক ভাবে শিক্ষকদের নতুন বিষয় সম্পর্কে প্রস্তুত
করে তোলার কোনও ব্যবস্থা নেই। গত ২০-২৫ বছরে সারা দেশে ক্লাস ঘর, বেঞ্চ, ব্ল্যাকবোর্ড ইত্যাদির উন্নতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ২০২০ পর্যন্ত চল্লিশ ভাগ স্কুলে বিদ্যুৎ ছিল না। কম্পিউটার, প্রোজেক্টরের কথা না তোলাই ভাল, সেগুলি শুধু ‘এলিট’ সম্প্রদায়ের জন্য।

যে প্রজন্ম স্মার্টফোনে দক্ষ, অথচ সাধারণ হিসাব-নিকাশ, ভাষার জ্ঞান ও ব্যবহারের মতো মৌলিক বিষয়গুলিতে দক্ষতা অর্জন করেনি, সেই প্রজন্মই হয়ে উঠবে ‘হোয়াটসঅ্যাপ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উপভোক্তা। ‘ছাত্র’ বললাম না, কারণ ছাত্র হতে গেলে প্রশ্ন করতে শিখতে হয়, উপভোক্তার কাজ হল হজম করা।

‘অসর’ সমীক্ষা একটা নতুন সামাজিক ছবির দিকে ইঙ্গিত করছে— দেশে শিক্ষিত প্রজন্ম তৈরি হচ্ছিল না অনেক দিনই, এখন কিন্তু তার পাল্টা একটা ‘বাজারের পাঠশালা’ গড়ে উঠেছে। বাজারের পাঠশালায় শৈশব থেকেই ছেলেমেয়েরা যা জানছে, বুঝছে ও শিখছে, সেটাই তাদের ভবিষ্যতের পাথেয় হবে। রাজনীতি, সমাজ, এবং ন্যায়-অন্যায়ের বোধও এই বাজারের পাঠশালা থেকেই তৈরি হচ্ছে ও হবে। আশঙ্কা হয়, এ ব্যাপারে ভারতের ‘বিশ্বগুরু’ হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Students India Economy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE