কালিম্পঙের ডেলো পাহাড়ের বৈঠক, আইআরসিটিসি-র সঙ্গে চুক্তির পরে এ বার রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে তিন হাজার অস্থায়ী কর্মী নিয়োগের সঙ্গেও সারদার যোগসূত্র ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে শুরু করল সিবিআই।
২০১২ সালের ৩০ মার্চ সারদা গোষ্ঠীর দৈনিক সংবাদপত্র ‘সকালবেলা’য় আট লাইনের একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, রাজ্য সরকারের কিছু বিভাগে জরুরি ভিত্তিতে অস্থায়ী ভাবে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নেওয়া হবে। ইচ্ছুক প্রার্থীদের সাত দিনের মধ্যে ওই কাগজের বক্স নম্বরে আবেদনপত্র জমা দিতে বলা হয়। এর পর ২৩ এপ্রিল সারদা প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন লিমিটেডের সিনিয়র গ্রুপ মিডিয়া ভাইস প্রেসিডেন্ট সোমনাথ দত্তের তরফে জনৈক মৃদুল মিত্র তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে জানান, ‘আমাদের কাগজে আপনার দেওয়া কর্মখালির বিজ্ঞাপনের’ উত্তরে ৪০১৫টি আবেদনপত্র জমা পড়েছে। পার্থবাবুর দফতরে যত শীঘ্র সম্ভব সেই আবেদনপত্রগুলি পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলেও ওই চিঠিতে জানানো হয়।
এই সংক্রান্ত নথিপত্র হাতে আসার পরে সিবিআই গোয়েন্দাদের একাংশ বলছেন, সরকারি পদে নিয়োগ করতে হলে পাবলিক সার্ভিস কমিশন, স্টাফ সিলেকশন কমিশনের মতো সংস্থা বিজ্ঞাপন দেয়। এর বাইরে যদি কোনও দফতর নিয়োগ করতে চায়, তা হলে তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা। এ জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে মেমো নম্বর দিয়ে বহুল প্রচারিত খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। যাতে অনেক প্রার্থী আবেদন করার সুযোগ পান।
ওই গোয়েন্দাদের মতে, সারদার তরফে পাঠানো চিঠির বক্তব্য যদি ঠিক হয়, তা হলে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন পার্থবাবু। মন্ত্রী হিসেবে তা তিনি পারেন না। ওই বিজ্ঞাপন দেওয়ার কোনও সরকারি আদেশনামাও ছিল না। এখন সিবিআইয়ের প্রশ্ন হল, আইন এড়িয়ে সারদা গোষ্ঠীর কম প্রচার সংখ্যার একটি কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল কেন? বিষয়টি সারদা কেলেঙ্কারির বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অঙ্গ কি না, তা খতিয়ে দেখতে চায় তারা।
পার্থবাবুর অবশ্য বক্তব্য, “এর সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম না। বিভিন্ন দফতর নিজের মতো করে লোক নিয়েছে। তবে জেনেছি, সরকারি নিয়ম মেনেই ওই নিয়োগ হয়েছিল।” চুক্তির ভিত্তিতে সরকারি পদে লোক নিয়োগ সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআইয়ের বিচার্য হতে পারে না বলেও দাবি করেছেন তিনি। পার্থবাবুর বক্তব্য, “এ নিয়ে আদালতে মামলা হয়। আদালতও এই নিয়োগ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি।”
কিন্তু সিবিআই সূত্রে বলা হচ্ছে, সারদা গোষ্ঠীর কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে যে সব আবেদনপত্র জমা পড়েছিল, তার ভিত্তিতেই নিয়োগ হয়েছিল কি না, সেটাই প্রশ্ন। তাদের কাছে খবর, ২০১২ সালেই মাসিক ৬৬০০ টাকা বেতনে মোট ৩০০০ জনকে নিয়োগ করেছিল রাজ্য সরকার। এবং গোটা প্রক্রিয়াটা নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন পার্থবাবু নিজে। এই নিয়োগের জন্য কোনও লিখিত পরীক্ষা হয়নি। শাসক দলের বিধায়কদের কাছ থেকে নামের তালিকা চেয়ে পাঠানো হয়েছিল। সেই তালিকা ঝাড়াই-বাছাই করে একই রকমের বয়ানের দরখাস্ত-সহ বিভিন্ন দফতরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওই দরখাস্ত থেকেই নিয়োগ করেছিল দফতরগুলি। সব চেয়ে বেশি নিয়োগ হয়েছিল বেহালা ও আলিপুর এলাকার বাসিন্দাদের।
এই পরিস্থিতিতে শাসক দলের কাছের লোকেদের কাজ পাইয়ে দিয়ে সারদা গোষ্ঠীর কাগজে বেআইনি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল কি না, এবং তার বিনিময়ে সারদা গোষ্ঠীকে কোনও সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল কি না, সেটাই খতিয়ে দেখতে চায় সিবিআই। সংস্থা সূত্রের খবর, এই ভাবে নিয়োগ করা নিয়ে রাজ্য সরকারি আমলাদের একটি অংশ আপত্তি তুলেছিলেন। কেন কম প্রচার সংখ্যার একটি কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল, সেই প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। শিল্প দফতরের অধীন একটি সংস্থা তো বিজ্ঞাপনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নিয়োগই করতে চায়নি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পার্থবাবু ওই সংস্থার কর্তাকে অন্যত্র সরিয়ে দেন।
সিবিআইয়ের এক কর্তার বক্তব্য, সারদা গোষ্ঠীর কাগজে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের উত্তরে আদৌ কোনও আবেদনপত্র জমা পড়েছিল কি না তা তদন্ত করে দেখা হবে। প্রাথমিক ভাবে গোয়েন্দাদের একাংশের ধারণা, আমলাদের প্রশ্ন এড়িয়ে নিয়োগকে আপাত বৈধতা দিতেই সারদা গোষ্ঠীর কর্তাকে দিয়ে ওই চিঠি লেখানো হয়ে থাকতে পারে। যদি তা হয়, তা হলে এই ঘটনা সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে যাবে।
প্রসঙ্গত, সারদার যে কর্তার তরফে ওই চিঠি লেখা হয়, সেই সোমনাথ দত্তকে গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। সদ্য তিনি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। সোমনাথের কাছ থেকে সারদা মামলায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি মিলেছে বলে তদন্তকারী সংস্থা সূত্রের দাবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy