মাতঙ্গ সিংহ ও মনোরঞ্জনা সিংহ
জেলের কুঠুরি এড়িয়ে যাতে বাইরে আরামে থাকা যায়, সে জন্য ওঁরা নাকি অসুস্থতার অজুহাত খাড়া করেছেন। অন্তত তদন্তকারীদের তেমনই দাবি।
তাই প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ মাতঙ্গ সিংহ ও তাঁর স্ত্রী মনোরঞ্জনা-সহ সারদা-কাণ্ডে ধৃত চার অভিযুক্তের শারীরিক অবস্থা যাচাই করতে এ বার দিল্লি থেকে চিকিৎসকদল কলকাতায় আসছে। এই মর্মে সিবিআইয়ের করা আবেদনটি বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্ট মঞ্জুর করেছে। মাতঙ্গ-মনোরঞ্জনা ছাড়া তালিকায় রয়েছেন শিল্পপতি শান্তনু ঘোষ ও অসমিয়া গায়ক সদানন্দ গগৈ।
সারদায় ধৃত অন্য অভিযুক্তেরা জেলে থাকলেও মাতঙ্গ-মনোরঞ্জনা-শান্তনু-সদানন্দ এই মুহূর্তে মহানগরের আলাদা আলাদা চারটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি। সিবিআইয়ের অভিযোগ: লাখ লাখ টাকা খরচ করে দিনের পর দিন তাঁরা কাটাচ্ছেন বিলাসবহুল স্যুটে। সেখানে নিকট আত্মীয়েরা সঙ্গ দিচ্ছেন, চেনা-পরিচিতদেরও নিত্য আনাগোনা। খাবার আসছে বাইরে থেকে। ‘‘যাঁদের জেলে থাকার কথা, তাঁরা স্রেফ টাকার জোরে আয়েসে দিন গুজরান করছেন,’’ আক্ষেপ তদন্তকারীদের।
এবং এ দিন এরই সুরাহা চেয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি নিশীথা মাত্রের এজলাসে হাজির হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর কৌঁসুলি কে রাঘবচারিলু। তাঁর দাবি— সরকারি ডাক্তারদের দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হোক, ওই অভিযুক্তেরা সত্যিই কতটা অসুস্থ। এ জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ নয়াদিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স (এইমস) থেকে চিকিৎসকদল আনার প্রস্তাব দেন সিবিআই কৌঁসুলি। বিচারপতি আবেদন মঞ্জুর করেন।
এমতাবস্থায় জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে যাতে দিল্লির ‘পরীক্ষকেরা’ এসে পরীক্ষা সেরে যান, তার তোড়জোড় চলছে বলে ব্যুরো-সূত্রের খবর। রাঘবচারিলু হাইকোর্টে এ-ও জানিয়েছেন, মাতঙ্গকে এইমসের ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করাতে তাঁরা ইতিমধ্যে আলিপুরের এসিজেএম আদালতে আবেদন করেছেন। আগামী ২৭ জুন তার শুনানি। পাশাপাশি তদন্তকারীদের একাংশের ইঙ্গিত, সদানন্দের অসুস্থতা সম্পর্কে খুব বেশি সন্দেহের জায়গা নেই। দক্ষিণ শহরতলির এক বেসরকারি হাসপাতালে গত মাস পাঁচেক যাবৎ ভর্তি আছেন সদানন্দ। ‘‘হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, ওঁর শরীর সত্যিই খারাপ। হেপাটাইটিস হয়েছে। ওজন কমছে দিন দিন,’’ মন্তব্য এক অফিসারের।
অর্থাৎ, মূলত তিন জনের ব্যাপারেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা বেশি মাত্রায় সন্দিহান। কী রকম?
প্রথমেই আসছে মাতঙ্গ সিংহের নাম। ২০০৪-এ তাঁর লিভার প্রতিস্থাপন হয়েছিল। সারদা-মামলায় গ্রেফতার হওয়া ইস্তক গত প্রায় দেড় বছরই তাঁর ঠিকানা জেলের বা বাইরের কোনও হাসপাতাল। কোর্টের নির্দেশে তিনি আপাতত যাদবপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু সিবিআইয়ের দাবি, লিভার প্রতিস্থাপনের পরে মাতঙ্গ অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেও অসুস্থতার দোহাই দিয়ে তিনি গারদ ফাঁকি দিচ্ছেন। তদন্তকারীদের প্রশ্ন— বারো বছর আগে কারও লিভার প্রতিস্থাপন হয়ে থাকলে তিনি এত দিন অসুস্থ থাকতে পারেন?
চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ: লিভার প্রতিস্থাপনের এত বছর বাদে তেমন কোনও শারীরিক সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সিবিআইয়ের অভিযোগ, মাতঙ্গের কৌঁসুলিরা বেশ ক’বার বলেছেন, তাঁদের মক্কেলের লিভারে নাকি কোমা হয়েছে! যদিও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বক্তব্য: লিভার কোমায় কারও সজ্ঞানে থাকারই কথা নয়!
মাতঙ্গের ক্ষেত্রে অবশ্য সংজ্ঞাহীনতার কোনও লক্ষণ নেই। বরং তিনি হাসপাতালে বসে দিব্যি নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ করছেন নানা লোকজনের সঙ্গে, ক’দিন আগেও যাঁদের অন্যতম ছিলেন তাঁর আপ্ত সহায়ক খ্যাতি সারদেনা। সম্প্রতি সিবিআইয়ের আপত্তিতে খ্যাতির নাম দর্শনার্থী-তালিকা থেকে বাদ গিয়েছে। সিবিআইয়ের অভিযোগ, ‘প্রভাবশালী’ ওই মহিলা মাতঙ্গের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে মামলার সাক্ষীদের প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন।
এ হেন পরিস্থিতিতে প্রাক্তন সাংসদের শারীরিক অবস্থা খুঁটিয়ে যাচাই করায় জোর দিচ্ছে সিবিআই। একই কারণে মনোরঞ্জনার হাসপাতালবাস নিয়েও তাদের ঘোরতর আপত্তি। মাতঙ্গ-পত্নী মনোরঞ্জনা রয়েছেন ইএম বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালের প্রেসিডেন্সি স্যুটে, আভিজাত্যে ও সুযোগ-সুবিধার নিরিখে যা কিনা পাঁচতারা হোটেলের সঙ্গে পাল্লা টানতে পারে। কোর্টের নির্দেশে ওখানে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছেন আত্মীয়-পরিজন, ‘শুভাকাঙ্খী’রা।
ব্যুরো-সূত্রের খবর: সারদা-কাণ্ডে মনোরঞ্জনা গ্রেফতার হন বছর দুয়েক আগে। কিন্তু একটি বারের জন্যও জেলের দরজা পেরোননি। জেরার জন্য কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারাও তাঁকে হেফাজতে পেয়েছেন সাকুল্যে চার দিন। কারণ, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ‘অসুস্থ’ হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান। প্রথমে এসএসকেএম। সেখান থেকে একবালপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালের প্রেসিডেন্সি স্যুট। মাস ছয়েক আগে সিবিআই ওখানে তত্ত্ব-তালাশ শুরু করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মনোরঞ্জনাকে অনুরোধ করেছিলেন অন্য কোথাও গিয়ে চিকিৎসা করাতে।
মনোরঞ্জনা তখনই চলে আসেন বাইপাসের হাসপাতালটিতে। সূত্রের খবর, দিনে ১৫ হাজার হিসেবে গত এক বছরে ওখানে থাকার পিছনে নয় নয় করে তিনি প্রায় আধ কোটি টাকা খরচ করেছেন! এ রাজ্যের শিল্পপতি শান্তনু ঘোষও কারাবাস এড়াতে ‘মিথ্যে অসুস্থতা’র যুক্তি সাজিয়েছেন বলে তদন্তকারীদের সন্দেহ। তিন মাস হল শান্তনু রয়েছেন দক্ষিণ শহরতলির এক হাসপাতালে।
ওঁদের সত্যিই রোগে ধরেছে, নাকি অসুখের ভান করছেন, এইমসের ছাঁকনিতেই তা ধরা পড়বে বলে আশা করছেন গোয়েন্দারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy