Advertisement
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে অসঙ্গতি, বিধায়ক খুনে প্রশ্ন ধৃতদের নিয়েও

সুজিতের বাড়ি থেকে কয়েক পা এগোলেই অন্য অভিযুক্ত কার্তিকের বাড়ি। রবিবার দুপুরে সেখানে পাওয়া গেল তাঁর বাবা, মা এবং স্ত্রীকে।

স্বামীর মৃত্যুতে কাতর বিধায়ক সত্যজিত্ বিশ্বাসের স্ত্রী রূপালী বিশ্বাস।—নিজস্ব চিত্র।

স্বামীর মৃত্যুতে কাতর বিধায়ক সত্যজিত্ বিশ্বাসের স্ত্রী রূপালী বিশ্বাস।—নিজস্ব চিত্র।

সিজার মণ্ডল
হাসখালি (নদিয়া) শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২০:১৯
Share: Save:

রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, না কি বিধায়ক খুনের পিছনে রয়েছে অন্য কোনও সমীকরণ? কৃষ্ণগঞ্জেতৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাস খুনের পর, জেলা থেকে শুরু করে শাসক দলের রাজ্য স্তরের নেতারা অভিযোগের আঙুল তুলেছেন বিজেপির দিকে। দলের নদিয়া জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে অভিযোগ করেছেন বিজেপি নেতা মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে। তাই খুনের পর মিলন দাস নামে এক প্রত্যক্ষদর্শীর করা প্রথম অভিযোগ পত্রে কোথাও মুকুল রায়ের নাম না থাকলেও, শীর্ষ পুলিশ কর্তাদের একাংশ জানিয়েছেন, এফআইআর-এ অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে মুকুল রায়ের নামও।

মজিদপুর ফুলবাড়ি ফুটবল ময়দান, যেখানে খুন হন সত্যজিৎ, সেখান থেকে কয়েকশো মিটার দূরে বাড়ি দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র শুভঙ্কর মণ্ডলের (নাম পরিবর্তিত)। রবিবার দুপুরে সে বলে, ঘটনার সময় সে বিধায়কের পাশেই দাঁড়িয়েছিল। তার কথায়— চেয়ারে বসা বিধায়কের ডানদিকে দাঁড়িয়ে ছিল অভিজিৎ পুণ্ডারী। সে শুভঙ্করদের পাড়াতেই থাকে। শুভঙ্কর বলে, “নীল রঙের চাদর গায়ে ছিল অভি়জিৎ কাকার। অনেক ক্ষণ ধরেই সত্যজিৎ কাকার পিছন পিছন ঘুরছিল। চেয়ারে বসার পর হঠাৎই চাদরের তলা থেকে বন্দুক বের করে। আমি ভেবেছিলাম খেলনা বন্দুক। তার পরই একটা আওয়াজ, ধোঁয়া। দেখি সত্য কাকা মাটিতে পড়ে রয়েছে।”

ওই ছাত্রের মতোই, আর এক প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় যুবক সলোমন দফাদার। তিনি বলেন, “আমি গুলির আওয়াজ হওয়ার পরেই অভিজিৎকে দৌড়ে পালিয়ে যেতে দেখি।” সলোমনের মত অনেকেই যাঁরা শনিবার ওই মাঠে ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা একজনকেই পালিয়ে যেতে দেখেছেন এবং সেই আততায়ীকে তাড়া করতে গিয়েই মাঠ থেকে আশি মিটার দূরে রাস্তার অন্য পারে একটি বাড়ির সামনে থেকে পাওয়া যায় একটি সিঙ্গল শুটার বন্দুক। অনুমান, আততায়ী ওই বন্দুক দিয়েই গুলি করেছিল বিধায়ককে এবং ফেলে পালিয়ে যায়।

অন্যতম অভিযুক্ত অভিজিতের বাড়ি ভাঙচুর করেন বিধায়কের সমর্থকেরা।—নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন: নদিয়া তৃণমূলের সভাপতির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ মুকুলের, পাত্তা দিচ্ছেন না গৌরী​

যদিও অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে মিলন দাস যে অভিযোগ করেছেন, তাতে তিনি লিখেছেন যে— সুজিত মণ্ডল, কালীপদ মণ্ডল এবং কার্তিক মণ্ডল নামে তিন যুবক বিধায়ককে জাপটে ধরে। তার পর বলে গুলি করতে। তখন অভিজিৎ গুলি করে। পুলিশ ইতিমধ্যেই এফআইআরে নাম থাকার সূত্রে গ্রেফতার করেছে সুজিত এবং কার্তিককে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের এই প্রকট ফারাক কিন্তু নজর এড়ায়নি পুলিশেরও। এফআইআরের দাবি অনুযায়ী সুজিত আর কার্তিক যদি সত্যিই গুলির আগে বিধায়ককে জাপটে ধরে থাকেন, তবে তাঁরা পালিয়ে না গিয়ে বাড়িতে বসে থাকলেন কেন, উপস্থিত লোকজন তাঁদের তাড়াই বা করলেন না কেন, সে প্রশ্ন উঠেছে।

যে অভিজিতকে গুলি করে বিধায়ককে খুন করতে দেখেছেন সবাই, বিধায়কের বাড়ি থেকে মেরেকেটে পাঁচশো মিটার দূরে তার বাড়ি। রবিবার সকালে গিয়ে দেখা গেল, শনিবার রাতে নিহত বিধায়কের সমর্থকরা ভাঙচুর করে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ফাঁকা বাড়ি। অভিজিতের প্রতিবেশি বিধান সাহা। তিনি বলেন, “অভিজিৎ বগুলা কলেজে পড়াকালীন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ করত। ইদানিং কোনও রাজনীতি করতে দেখিনি।” তার ঘরে গিয়ে দেখা গেল এলোমেলো অবস্থায় পড়ে রয়েছে বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড।

পরিবার-পরিজনদের মাঝে বিধায়কের স্ত্রী ও ছেলে।—নিজস্ব চিত্র।

বিধানের মতোই অভিজিৎদের আর এক প্রতিবেশী পতিত সাহা। তিনি বলেন, “ছেলেটি একটু একা থাকত। বিশেষ কারওর সঙ্গে মিশত না।” তবে প্রতিবেশীরা জানালেন, কয়েক মাস আগে বিধায়কের উপস্থিতিতেই তাঁর লোকজন অভিজিৎকে বেশ ভাল রকম মারধর করে। যদিও কারণটা রাজনৈতিক নয়। পারিবারিক। অভিজিৎ তাঁর বৌদিকে গালিগালাজ করেছে এমনটাই বিধায়কের কাছে অভিযোগ করেছিলেন অভিজিতের দাদা প্রসেনজিৎ। তার জেরেই ‘শাসন’, দাবি ওই পাড়ারই বাসিন্দা মজিদপুর দক্ষিণ পঞ্চায়েতের প্রধান লিপিকা বিশ্বাসের। তবে ওই কারণে অভিজিৎ বিধায়ককে খুন করবে, এমনটাও মানতে পারছেন না এলাকার মানুষ। যদিও প্রতিবেশীদের দাবি, মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যেত অভিজিৎ। কয়েক মাস পরে ফিরত। কোথায় যেত তা জানেন না কেউ। রবিবার স্থানীয়রা অভিজিতের বাড়িতে খাটের তলায় একটি সদ্য খোঁড়া গর্ত আবিস্কার করেন। তাঁদের সন্দেহ, ওখানেই বন্দুক লুকিয়ে রেখেছিল সে। কিন্ত পাড়ার কেউই অভিজিতের সঙ্গে বাকি অভিযুক্তদের কোনও যোগাযোগ মনে করতে পারেননি।

অভিজিতের বাড়ি পেরিয়ে কয়েকশো ফুট এগোলেই বাড়ি অন্যতম অভিযুক্ত সুজিত মণ্ডলের। তার মা ভানু মণ্ডল রবিবার দুপুর পর্যন্ত জানতেন না যে তাঁর ছেলেকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তিনি বলেন, “রাতে দু’বার পুলিশ এসেছিল ছেলের খোঁজে।” সুজিতের ঘরে গিয়ে দেখা গেল দেওয়ালে টাঙানো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দু’টি ল্যামিনেটেড ছবি। ভানুর দাবি, মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই ওই ছবি রয়েছে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫৬ শতাংশ নম্বর নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক সুজিত মানসিক রোগে ভুগছেন এমনটাও দাবি তাঁর মায়ের। সম্প্রতি কখনও রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ বা কখনও লরির খালাসির কাজ করতেন। ভানুর দাবি, শনিবারও তিনি লরির খালাসির কাজেই বেরিয়েছিলেন। তবে পাড়ার লোকজন কেউই তাঁকে সক্রিয় বিজেপি কর্মী বা সমর্থক হিসাবে দাবি করেননি।

সুজিতের বাড়ি থেকে কয়েক পা এগোলেই অন্য অভিযুক্ত কার্তিকের বাড়ি। রবিবার দুপুরে সেখানে পাওয়া গেল তাঁর বাবা, মা এবং স্ত্রীকে। ওই এলাকার লোকজন কয়েক মাস আগে পর্যন্তও কার্তিককে জানতেন বিধায়কের ছায়াসঙ্গী হিসাবে। সে কথা স্বীকার করেন তাঁর বাবা জানকীও। তবে কালীপুজোর পর থেকে তাঁর সংঘাত তৈরি হয় বিধায়কের সঙ্গে।

কার্তিকের স্ত্রী সুনীতার অভিযোগ, “কালীপুজোর সময়ে পাড়ায় একটি গণ্ডগোলকে কেন্দ্র করে বিধায়ক কার্তিককে মারধর করেন।” ওই পাড়ারই বাসিন্দা অপর্ণা বিশ্বাসের দাবি, কার্তিকের সঙ্গে শত্রুতা ছিল এলাকার তৃণমূল পঞ্চায়েত প্রধান লিপিকা বিশ্বাস এবং ওই পাড়ার অন্য এক নেতা উজ্জ্বল বিশ্বাসের। তাঁদের মারধরও করে কার্তিক এবং তাঁর দলবল। তা নিয়েই বিধায়কের সঙ্গে গণ্ডগোল। এর পর থেকেই কার্তিক নিজেকে বিজেপি কর্মী হিসাবে পরিচয় দিতে শুরু করেন। তবে কার্তিকের বাবার দাবি, গণ্ডগোলের পর থেকেই আর কোনও রাজনীতি করতেন না তাঁর ছেলে। বাড়িতে দর্জির কাজ করতেন। শনিবার রাতে বাড়ি থেকেই পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে।

ধৃত কার্তিকের বাবা-মা।—নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন: অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই কি কাল হল সত্যজিতের? প্রশ্ন উঠছে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়েও​

এই ঘটনায় অন্য অভিযুক্ত কালীপদর বাড়ি ওই একই পাড়ায়। কার্তিকের খুড়তুতো ভাই। পেশায় রং-মিস্ত্রি। তাঁকে বাড়িতে পাওয়া গেল না। তার বাবা মুক্তিপদ বলেন, শনিবার দুপুরেই অসুস্থ শাশুড়িকে দেখতে শান্তিপুরে গিয়েছেন তাঁর ছেলে। তিনি স্বীকার করেন, পুলিশ রাতে খোঁজে এসেছিল। তিনি ছেলেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতে বলেছেন। তবে মুক্তিপদ বা কালীপদের স্ত্রী স্বপ্না স্বীকার করেন, কালী পুজোর গণ্ডগোলের সময় কার্তিকের সঙ্গে সেও ছিল এবং ইদানীং বিজেপি করছিল। তবে এলাকার মানুষ কেউই বলতে পারলেন না কার্তিক বা কালীপদদের নেতা কে।

বিধায়কের খাস তালুকে, তাঁরই অনুগত কয়েক জন, বিধায়কের সঙ্গে বিবাদের জেরেই বিজেপি করা শুরু করেন এটা হয়ত ঠিক। কিন্তু স্রেফ এটার জেরে, তাঁরা বিধায়ককে খুন করে দিলেন, এই মোটিভ কতটা জোরাল তা নিয়ে সংশয়ে জেলা পুলিশের কর্তারাও। অন্য দিকে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুসারে আততায়ী একজন এবং সে অভিজিৎ। তার সঙ্গে এই বাকি তিন জনের কোনও যোগ সূত্র পাচ্ছেন না এলাকার মানুষও। সে বিজেপি করত, এমন দাবিও করেননি এলাকার মানুষ। আর সেখানেই আরও ফিকে হয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মোটিভ।

এর সঙ্গেই যোগ হচ্ছে আরও কয়েকটি প্রশ্ন। যদি রাজনৈতিক শত্রুতার জেরে পরিকল্পনা করে এই খুন হয়, তা হলে কেন তারা এ রকম আনকোরা এলাকায় অতি পরিচিত কয়েক জন যুবককে খুনের দায়িত্ব দেবে? সে ক্ষেত্রে পেশাদার অপরাধী নিয়োগ করলে ধরা পড়ার সম্ভবনা অনেক কম থাকত। আর সেখানেই প্রশ্ন উঠছে— খুনের পিছনে কি আদৌ কোনও বড় সংগঠিত ষড়যন্ত্র রয়েছে, না কি অন্য কিছু? পুলিশ খুঁজে দেখছে সব দিকই।

(বাংলার রাজনীতি, বাংলার শিক্ষা, বাংলার অর্থনীতি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার স্বাস্থ্য, বাংলার আবহাওয়া -পশ্চিমবঙ্গের সব টাটকা খবর আমাদের রাজ্য বিভাগে।)

অন্য বিষয়গুলি:

Krishnaganj TMC MLA Murder Crim TMC MLA Murder Hanshkhali Nadia shoot out
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy