Advertisement
E-Paper

শূন্যতার চেয়েও যৌনতা এখন সিপিএমের বড় বিড়ম্বনার কারণ, এক বছরে সাতকাণ্ডের ‘যৌনায়ন’! অস্বস্তি কাটছে না আলিমুদ্দিনের

সিপিএম এই প্রবণতাকে কোনও নির্দিষ্ট বয়সের গণ্ডিতে বাঁধতে পারছে না। অর্থাৎ, শুধুমাত্র কমবয়সিরাই যে যৌনতায় ‘আসক্ত’ হয়ে পদস্খলিত হচ্ছেন তা নয়। সাতকাণ্ড বলছে, তালিকায় যেমন তরুণেরা রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন পঞ্চাশের দোরগোড়ায় পৌঁছোনো নেতা। ষাটোর্ধ্ব নেতারাও পাল্লা দিচ্ছেন।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২৫ ০৯:০০
Seven incidents in one year have increased the discomfort of West Bengal CPM

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ভোটে শূন্যতা কাটছে না। তা নিয়ে বিড়ম্বনাও কম নেই। কিন্তু শূন্যতার চেয়েও বড় বিড়ম্বনা এখন বঙ্গ সিপিএমকে তাড়া করছে। যৌনতা। নেতারা একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন, দলের একাংশের নেতার যৌন আকাঙ্ক্ষা দলকে অস্বস্তির কানাগলি থেকে বেরোতেই দিচ্ছে না। ফলে শূন্যতার বিড়ম্বনা ছাপিয়ে যাচ্ছে যৌনতা।

পরিস্থিতি এমনই যে, একটি ঘটনা থিতিয়ে যেতে না যেতেই আরও একটি ঘটনা প্রকাশ্যে চলে আসছে। ঘটনাক্রম বলছে, ২০২৪ সালের অগস্ট থেকে ২০২৫ সালের অগস্ট— এক বছরে একদা বাংলার শাসকদলের অন্দরে যা যা ঘটেছে, তাকে রসিক নেতারা সাতকাণ্ডের রামায়ণের সঙ্গে তুলনা করে ‘যৌনায়ন মহাকাব্য’ বলতে শুরু করেছেন।

দলের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের রাজ্য কমিটির এক সদস্য তথা দমদম-লেকটাউন এলাকার এক ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে যৌনগন্ধী অভিযোগ তুলে সংগঠনের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন এসএফআইয়েরই এক নেত্রী। সেই সূত্রেই দলের মধ্যে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে এই প্রবণতা নিয়ে। দমদমের ঘটনাটি-সহ যে সাতটি ঘটনা গত এক বছরে ঘটেছে, তা নিয়ে সিপিএম অন্য রকম ফাঁপরে পড়েছে। কারণ, তারা এই প্রবণতাকে কোনও নির্দিষ্ট বয়সের গণ্ডিতে বাঁধতে পারছে না। অর্থাৎ, শুধুমাত্র কমবয়সিরাই যে যৌনতায় ‘আসক্ত’ হয়ে পদস্খলিত হচ্ছেন তা নয়। সাতকাণ্ড বলছে, তালিকায় যেমন তরুণেরা রয়েছেন, তেনই রয়েছেন পঞ্চাশের দোরগোড়ায় পৌঁছোনো নেতা। ষাটোর্ধ্ব নেতারাও পাল্লা দিচ্ছেন। বস্তুত, যৌনতার প্রশ্নে কোনও কোনও ক্ষেত্রে নবীনদেরও টেক্কা দিচ্ছেন প্রবীণেরা।

সুশান্তকাণ্ড

গত বছর অগস্ট মাসে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষের একটি ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসে পড়ে। সেই সময়ে সুশান্ত ছিলেন সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক। ‘মুখরক্ষায়’ সুশান্তকে ‘ছুটিতে’ পাঠায় সিপিএম। অস্থায়ী ভাবে জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় অন্য এক জনকে। পরে সুশান্তকে জেলা কমিটি এবং রাজ্য কমিটি থেকে সরিয়ে দেয় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। যা এক প্রকার ‘শাস্তি’ হিসাবেই বিবেচিত হয়েছে দলে।

তন্ময়কাণ্ড

সুশান্তকে নিয়ে অস্বস্তি প্রশমিত হওয়ার আগেই গত বছর অক্টোবরে বিতর্কে জড়ান উত্তর দমদমের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য। এক মহিলা সাংবাদিককে হেনস্থার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। কালক্ষেপ না-করে তন্ময়কে সাসপেন্ড করে সিপিএম। তার পর শুরু হয় দলীয় তদন্ত। তা শেষ হওয়ার পরে সাসপেনশন প্রত্যাহার করে আলিমুদ্দিন। কিন্তু শাস্তিমূলক পদক্ষেপ হিসাবে ফের তন্ময়কে ছ’মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়।

সোমনাথকাণ্ড

পশ্চিম মেদিনীপুর, উত্তর ২৪ পরগনা হয়ে নভেম্বরে বিতর্ক পৌঁছোয় কলকাতায়। টালিগঞ্জের তরুণ নেতা সোমনাথ ঝা-র বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তোলেন সিপিএমেরই দুই পার্টি সদস্যের কন্যা (তাঁদের এক জন নিজেও পার্টি সদস্য)। ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডের এই নেতা কয়েক বছর আগে দলের এক যুবতী কর্মীকে রাস্তায় ফেলে পেটানোর অভিযোগে সাসপেন্ড হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধেই ফের অভিযোগ ওঠায় তাঁকে বহিষ্কার করে ক্যাল ডিসি (সিপিএমের কলকাতা জেলা কমিটি)।

বেলঘরিয়াকাণ্ড

বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস-সহ একাধিক অভিযোগ ওঠে এক রাজ্য কমিটি সদস্যের বিরুদ্ধে। এপ্রিলের গোড়ায় যখন তামিলনাড়ুর মাদুরাই শহরে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস চলছে, তখনই ওই নেতার নানাবিধ ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে (সেগুলির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার ডট কম)। রাজ্য কমিটির ওই সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন বেলঘরিয়ার এক সিপিএম সদস্যা। সেই অভিযোগ দলের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটিতে জমা পড়েছে। কিন্তু এখনও কোনও ফয়সালা হয়নি। তদন্তে কেন দীর্ঘসূত্রিতা, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে সিপিএমের অন্দরে। অভিযোগ, অন্য এক জন রাজ্য কমিটির সদস্য অভিযোগকারিণীকে এ সব থেকে বেরিয়ে আসতে বলে ফোন করে ‘চাপ’ দিচ্ছেন। পাল্টা সিপিএমের মহিলা ব্রিগেডের একাংশ বেলঘরিয়ার তরুণীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। সমাজমাধ্যমে লেখালেখিও শুরু হয়েছে। এর মধ্যে দলের প্রথম সারির এক নেত্রী অভিযোগকারিণীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছেন বলে খবর।

ডিওয়াইএফআইকাণ্ড

এপ্রিলের মাঝামাঝি সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের কলকাতা জেলা সম্মেলনের পরে আবার অস্বস্তি বাড়ে সিপিএমের। জেলা সংগঠনের সর্বোচ্চ দু’টি পদের একটিতে এমন এক জনকে বসানো হয়, যাঁর বিরুদ্ধে এক তরুণীকে হেনস্থার অভিযোগ আগে থেকেই ছিল। সেই তরুণী গত পুরভোটে মধ্য কলকাতার একটি ওয়ার্ডে সিপিএমের প্রার্থীও ছিলেন। সংশ্লিষ্ট নেতা দায়িত্ব পাওয়ার পরেই পুরনো অভিযোগ নতুন করে ওঠে। সূত্রের খবর, ওই তরুণী কলকাতা জেলা সিপিএমে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি এখনও বৈঠক করেনি বলেই খবর প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবন সূত্রে।

বংশগোপালকাণ্ড

এপ্রিলের শেষে সিপিএমের বিড়ম্বনা আরও বাড়িয়ে দেন রাজ্যের আর এক প্রাক্তন মন্ত্রী তথা আসানসোলের প্রাক্তন সাংসদ বংশগোপাল চৌধুরী। মুর্শিদাবাদের এক নেত্রী তথা জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পুরসভার প্রাক্তন সিপিএম কাউন্সিলরকে সমাজমাধ্যমে নানা কুরুচিকর বার্তা পাঠানোর অভিযোগ ছিল বংশগোপালের বিরুদ্ধে, যা কার্যত ‘ভার্চুয়াল’ যৌন হেনস্থার পর্যায়ে পড়ে। সেই মর্মেই অভিযোগ এসেছিল সিপিএমের কাছে। তার ভিত্তিতে দলীয় স্তরে তদন্ত শুরু করে আলিমুদ্দিন। বংশগোপালের ঘটনাতেও তদন্তের দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ উঠেছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত ২৬ এপ্রিল বংশগোপালকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় সিপিএম। প্রসঙ্গত, নিজের বহিষ্কারের খবর আনন্দবাজার ডট কম পড়েই জেনেছিলেন বংশগোপাল। পরে খেদের সঙ্গে সাংবাদিক বৈঠকে বলেছিলেন, ‘‘পার্টি আমায় কিছু জানাল না! আনন্দবাজার ডট কম পড়ে আমায় জানতে হল, আমায় বহিষ্কার করা হয়েছে।’’

দমদমকাণ্ড

তালিকায় নবতম সংযোজন দমদমের ছাত্রনেতা। জেলা এসএফআইকে লেখা চিঠিতে অভিযোগকারিণী দাবি করেছেন, ওই ছাত্রনেতা তাঁকে বারংবার মদ্যপানের প্রস্তাব দিতেন। দমদম ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় তাঁর ফাঁকা ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু তরুণী তা প্রত্যাখ্যান করেন। তার পরেও চলতে থাকে উত্ত্যক্ত করা। অভিযোগ, যৌন সম্পর্কের জন্য ধারাবাহিক ভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছিল তাঁকে। তরুণী তাঁর অভিযোগপত্রে আরও লিখেছেন, ছাত্রনেতা তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন রাজ্য সিপিএমের ফেসবুক পেজে সংবাদ সঞ্চালিকা হিসাবে সুযোগ করে দেবেন। যৌন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তা আর করা হয়নি। তরুণীর এমনও অভিযোগ যে, তাঁকে দিয়ে অন্য এক ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ সাজানোর চেষ্টা করেছিলেন ওই তরুণ তুর্কি।

প্রসঙ্গত, অভিযুক্ত যে নেতাদের বিরুদ্ধে দলীয় পর্যায়ে সিপিএম ইতিমধ্যেই শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করেছে, তাঁদের নামই কেবল আনন্দবাজার ডট কম-এ উল্লেখ করা হল। কারণ, তাঁরা দলীয় তদন্তে ‘দোষী’ প্রমাণিত হয়েছেন। সেই প্রেক্ষিতে তাঁরা শাস্তিও পেয়েছেন। যাঁদের বিরুদ্ধে এখনও দলীয় স্তরে অভিযোগ ‘প্রমাণিত’ হয়নি, সিপিএম যাঁদের ক্ষেত্রে এখনও কোনও পদক্ষেপ করেনি বা তদন্ত চলছে, তাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে দলীয় স্তরে অভিযোগের সাপেক্ষে যে যে স্ক্রিনশট, ছবি বা অডিয়ো ক্লিপিং জমা পড়েছে, সেগুলির সবক’টিই আনন্দবাজার ডট কম-এর হেফাজতে রয়েছে।

১২ মাসের যৌনতামিশ্রিত এই সাতকাণ্ডের মহাকাব্যে সিপিএম কতটা অস্বস্তিতে? দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘অস্বস্তি আছে বলেই তো আমরা দলীয় স্তরে এই ধরনের ঘটনায় পদক্ষেপ করি। তার ব্যবস্থাও তৈরি করা হয়েছে। তাতে ভরসা আছে বলেই অভিযোগ আসছে এবং তদন্ত হচ্ছে। এখানেই আর পাঁচটা দলের থেকে আমরা আলাদা। আমরা কাউকেই রেয়াত করি না।’’ কিন্তু এ তো ‘আনুষ্ঠানিক’ প্রতিক্রিয়া! দলের অনেকে মনে করছেন, পারস্পরিক সম্পর্ক, যৌন চাহিদা মেটানো বা না-মেটানোর সূচক অনেক ক্ষেত্রে কমিটিতে স্থান পাওয়া বা না-পাওয়ার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যাকে ‘ভয়ঙ্কর প্রবণতা’ বলে মনে করছেন সিপিএমের অনেক প্রবীণ নেতা। সিপিএমের ‘শূন্যদশা’ নিয়ে বিরোধীরা প্রায়ই কটাক্ষ করে। এমনও বলা হয় যে, সিপিএমে এখন ‘আর্যভট্টদশা’ চলছে। দক্ষিণবঙ্গের এক নেতা অবশ্য বলছেন, ‘‘আজ নয় কাল আর্যভট্টদশা কাটবে। কিন্তু পার্টির বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে এই বাৎস্যায়নদশা!’’

sex scandals CPM
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy