অদম্য: জিৎ ঘোষ। নিজস্ব চিত্র।
পেটের চিন্তাতেই আমাদের মতো যাযাবর সম্প্রদায়ের সময় চলে যায়। সেখানে বই, খাতা, পেন-পেনসিল নিয়ে পড়াশোনা বিলাসিতা ছাড়া আর কী! এই নিয়ে আমাকে কম কথা শুনতে হয়নি। তবু জেদ চেপে গিয়েছিল— আমাকে পারতেই হবে। পেরেওছি। এ বছর আমি মাধ্যমিক পাশ করেছি।
শুধু এই কথায় মনে হয় পরিস্থিতিটা বোঝানো কঠিন। তার থেকে বরং আমাদের গল্পটা আগে বলি।
আমরা যাযাবর। এত দিন পর্যন্ত আমার বাপ-ঠাকুরদার ভবঘুরে জীবনই কেটেছে। তার পরে এক দিন যখন গড়বেতার গনগনিতে আমরা ঘর বেঁধে কিছুটা থিতু হলাম, তখন সকলের মাথায় এল, এ বারে যদি ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা শেখে! সে বছর পনেরো আগেকার কথা। আধার, ভোটার বা রেশন কার্ড— কিছুই তো ছিল না। সে সব তৈরি হবে। সরকারি লোকজন এল। তখন আমরা নতুন পদবি পেলাম, ঘোষ। আমাদের মহল্লায় এখন সবাই ঘোষ।
মাধ্যমিককে অনেকে বলে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা। আমি তো এমন কত বড় পরীক্ষাতেই বসেছি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা ঘুরতেন। টুকটাক কাজ ছাড়া কার্যত ভিক্ষাবৃত্তি করেই চলত তাঁদের। আমরা তিন ভাই, চার বোন। আমাদের ছেলেবেলাটা কেটেছে প্রথমে হলদিয়ায়। সেখান থেকে গড়বেতা স্টেশন চত্বরে। তার পরে এখানে, গনগনিতে। কখনও তাঁবু খাটিয়ে, দোকানের শেডে, কখনও বা স্টেশনে স্টেশনে। এখন আমাদের স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে। গড়বেতার অনেক মানুষ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
শুরুতে অবশ্য পরিস্থিতিটা এমন ছিল না। তখন দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড়ের মতোই ক্লাসঘরে ঢুকতে পারা ছিল আমাদের জীবনে বড় ঘটনা। আইসিডিএস কেন্দ্রে যাওয়া বা প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি— প্রায় সব ক্ষেত্রেই ‘যাযাবরদের ছেলে’ বলে কার্যত তাড়িয়ে দেওয়া হত। প্রাথমিক স্কুলে আমার আশেপাশে কেউ বসত না। প্রাথমিকের দিদিমণি রেবা ধর সেই সময় আমাকে খুব সাহায্য করেন। তিনি না পড়ালে আমি হয়তো এত দূর আসতে পারতাম না। পরে হাই স্কুলেও ভর্তি নিচ্ছিল না। মোহনলাল বিষুই নামে এক শিক্ষকের প্রচেষ্টায় সেখানে ভর্তি হই। অনেক সময় আমি বসলে সেই বেঞ্চে সহপাঠীরা কেউ বসত না।
তবু হাল ছাড়িনি। বাবা সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। বাবার ইচ্ছে ছিল, ছেলেরা পড়ুক। এক ভাই দশম পর্যন্ত পড়ে ছেড়ে দিয়েছে। ছোট ভাই প্রাথমিকে পড়ছে। বাবা-মা আর ঘোরাঘুরি করেন না। তাঁরা ইটভাটায় দিনমজুরের কাজ করেন। আমি মাধ্যমিক পাশ করার আগেই একটা
সংস্থায় সেলসম্যানের কাজে ঢুকেছি।
তবে পড়া ছাড়ছি না। মাধ্যমিক পাশ করে গড়বেতা হাই স্কুলে ভোকেশনাল কোর্সে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছি। লক্ষ্য কলেজ পাশ করা। আরও একটা লক্ষ্য রয়েছে। আমাদের গোষ্ঠীর যে ছেলেমেয়েরা বই নিয়ে আমার কাছে চলে আসে, তাদের এগিয়ে যেতে শেখানো। এখনও আমাদের সমাজে কম বয়সে বিয়ে হয়। জন্মনিয়ন্ত্রণের বালাই নেই। গরিবি নিত্য সঙ্গী। পড়াশোনাই পারবে এ সব থেকে আমাদের স্বাধীন করতে।
ওদের পাশে রয়েছি আমি। দিনের শেষে আমার একটাই মন্ত্র: হার নয়, জিৎ।
অনুলিখন: রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy