দুর্গাপুজো মানেই দেদার আড্ডা। এন্তার চা-কফি। পোশাকি পোশাক ছেড়ে বাঙালি বেশভূষা। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে চোরা চাহনির চাখাচাখি। আর লাঞ্চ-ডিনারের অঢেল আয়োজন। অনেক আবাসনে আবার অরন্ধন চলে। ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার, সবই যৌথ সংসার। স্বপ্নের মতো সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী কেটে যায়। সন্ধেয় হেমন্তকণ্ঠী, কিশোরকণ্ঠী, মান্নাকণ্ঠীদের নিয়ে জমাট জলসা। তবে এত কিছুর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল পাড়ার প্যান্ডেলে বারোয়ারি পুজোয় বা আবাসনে, সদস্য-সদস্যাদের নাট্যাভিনয়ে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। কর্পোরেট মুখার্জিসাহেবের সঙ্গে এ বারের নায়িকা ব্যানার্জিগিন্নির রোম্যান্টিক সিনগুলো এ বার যেন একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ। তাতেই বোস-ঘোষ-চক্রবর্তীদের মধ্যে ফিসফাস। এই সব গুঞ্জনের গুঞ্জরণে গুলিয়ে যায়, থিয়েটার একটা সিরিয়াস আর্ট ফর্ম, না কি নিছকই বিনোদন। দু’-একটা ঘটনা বললে আমার কথার সত্যতা প্রমাণ হবে।
কলকাতা থেকে খুব দূরে নয়, হুগলির দশঘরা গ্রামের কথা বলছি। সেখানে ফি-বছর দুর্গাপুজো হত বেশ জাঁক করে। তবে তাকে বৈভব বলা চলে না। বরং আন্তরিকতা থাকত পুজোর পরতে পরতে। বিশাল পরিবারে এখন সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কেউ বড় চাকুরে, কেউ বা অধ্যাপক। কেউ ডাক্তার, প্রযুক্তিবিদ। পেশাগত কারণে কেউ ভারতের অন্য প্রদেশে, কেউ বা ভারতের বাইরে। এই দুর্গাপুজোর সময় এঁরা সবাই মিলিত হন দশঘরায়। আকর্ষণ দু’টিই আছে। একটি পুরনো আত্মীয়দের সঙ্গে মিলিত হওয়া, অন্যটি নাট্যাভিনয়। প্রবীণ ও নবীনরা একসঙ্গে মেতে ওঠেন অভিনয়ে। মহলার সময় কম পাওয়া যায় বলে তাঁরা ভরসা করেন ভগবানকে নয়, প্রম্পটারকে। পড়শি গ্রাম থেকে এসে পড়েন দুঁদে প্রম্পটার। পাঁচ দিনের মধ্যে তুলিয়ে দেন ডায়ালগের স্ক্যানিং, কম্পোজিশন, কোন রিকুইজিশন নিয়ে শিল্পীদের ঢুকতে হবে— এই সব। স্মৃতিভ্রংশ হওয়ায় নায়ক যখন মঞ্চে অসহায়, নায়িকার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন, তখন উইংসের ধার থেকে ফিসফিস করে প্রম্পটার বলে দিচ্ছেন, ‘‘তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না মীরা। তুমি ছাড়া আমি একটা অচল পয়সা।’’ আসলে প্রম্পটার জানেন, ডায়ালগ যেই লেজের অংশে এল, তখনই তার পরের অংশটি মুখে জুগিয়ে দেবেন প্রম্পটার। তবেই নাটক চলবে তরতরিয়ে। হোঁচট খেতে হবে না নায়ক-নায়িকাকে। ওই যে বললাম, ভগবান নয়, ফাঁকিবাজ অভিনেতাদের কাছে প্রম্পটারই গোটা নাট্যের নিয়ন্ত্রক।
আর একটি ঘটনা। কলকাতার সল্টলেকের এক আবাসন। সেখানেও অষ্টমীর রাতে চলেছে জমজমাট একটি নাটক। অভিনেতাদের অনেকেই উচ্চপদস্থ কেন্দ্রীয় কর্মী। এখানেও রিহার্সালের জন্য বেশি সময় পাওয়া যায়নি, ফলে অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও উইংসের ধার ঘেঁষে সংলাপ আওড়াচ্ছিলেন। স্টেজের মাঝ বরাবর যাওয়ার মতো অবস্থা নেই তাঁদের। কারণ যে কোনও মুহূর্তেই ফসকে যেতে পারে প্রম্পটারের ছুড়ে দেওয়া সংলাপ। এ দিকে পুজোর সময় অডিয়েন্সে একটু-আধটু আলাপচারিতা চলবে, এ সব সামলে নিয়ে ঠিক সংলাপটি বলে দেওয়াটা একটু মুশকিলের হতেই পারে। গত কয়েক বছর আগে অডিয়েন্সের গোলমাল এবং অভিনেতার সংলাপ বিস্মরণে সব তালগোল পাকিয়ে গেল। অনন্যোপায় হয়ে উদ্যোক্তারা পরদা ফেলে দিয়ে ঘোষণা করলেন, অনিবার্য কারণবশত নাটক কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রইল। পরবর্তী ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করুন। ফলে অডিয়েন্সে আরও গুঞ্জন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অপোনেন্ট পার্টির কেউ এসে উদ্যোক্তাদের অপদস্থ করার জন্য (কারণ নাটকটি ভালই চলছিল) দু’জন প্রম্পটারকে গুলি খাইয়ে দিয়েছিল। ফলত প্রম্পটারদের কথাগুলি ক্রমান্বয়ে জড়াতে জড়াতে শেষে ওরা দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়ে। ওদের মুখে জলটল দিয়ে ফের নাটক শুরু হয়। যত দূর জানা যায়, তার পর আর কোনও রকম বিপত্তি হয়নি।
আর এক পাড়ার থিয়েটারে ঘটেছিল আর এক কাণ্ড। সে বার রিহার্সাল ভাল হয়নি। ফলে যেমন-তেমন করে নাটকটি চলছিল। মাঝে মাঝে শিল্পীরা হোঁচটও খাচ্ছিলেন। কিন্তু সামলেসুমলে চালিয়েও যাচ্ছিলেন। নাটকটির যিনি পরিচালক, তিনি নাটক ছাড়া সব বিষয়েই করিৎকর্মা ছিলেন। তিনি এক বার বিরতির সময় সব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জড়ো করে বললেন, নাটকটি যেহেতু দেরিতে শুরু হয়েছে, তাই তাড়াতাড়ি শেষ করে দেওয়াই ঠিক হবে। এর অবশ্য আর একটি কারণও ছিল। সে দিন অভিনয়ের শেষে অভিনেতা-অভিনেত্রী-প্রম্পটার-পরিচালক-লাইটম্যান সবার একসঙ্গে ভোজনের আয়োজন ছিল। কলাকুশলীদের অর্ডার করা চাইনিজ খাবার আগেভাগেই গ্রিনরুমে এসে পৌঁছেছিল। আর কে না জানে, চাইনিজ খাবার গরম না থাকলে অখাদ্য হয়ে যায়! তাই পরিচালকমশাইও কোনও রকম কম্প্রোমাইজ না করে নাটকটির দু’টি সিন ছেঁটে দিলেন এবং সবাই মিলে গরম চাইনিজ খাবার খেয়ে যারপরনাই তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে বাড়ি ফিরলেন।
লেক টাউনের একটি পুজোয় প্রতি বারই নায়কের চরিত্রে নামেন এক জন সত্তরোর্ধ্ব ব্যবসায়ী। যাঁর টাকা অঢেল কিন্তু অভিনয়ক্ষমতা ততখানি নয়। প্রতি বারই তাঁর জন্য নায়কের চরিত্রটি বাঁধা, কারণ তিনি মোটা অঙ্কের চাঁদা দেন। প্রতি বছর তাঁর বয়স কমে যায়। এই ভাবেই বছরের পর বছর চলছে। এক বারই নাকি একটি মেয়ে প্রতিবাদ করে বলেছিল, জেঠুর সঙ্গে আমি নায়িকা করতে পারব না। ফলে জেঠু থেকে যান, সঙ্গে নতুন নায়িকা। এই গল্পগুলো শুনলে মনে হয়, এগুলো কি সত্যি হওয়া সম্ভব? কিন্তু বিশ্বাস করুন, এগুলো গল্প নয়, সব সত্যি ঘটনা।
আর একটি ঘটনার কথা বলছি। এটি অবশ্য কলকাতার নয়। পুণের বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন-এর একটি নাটকের কথা। নাটকটি ছিল এক হতদরিদ্র পরিবারকে নিয়ে। নায়িকা খুবই সংগ্রামী, দুঃখী। চরিত্রটি করছিলেন এক অভিজাত মহিলা, অধ্যাপনা করেন। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, প্রতিটি দৃশ্যে তিনি পরেছেন কাঞ্জিভরম, কোনওটিতে বমকাই, আবার কোনওটিতে বেঙ্গালুরু সিল্ক। ওই রকম একটি গরিব পরিবারের মেয়ে কী করে এত দামি শাড়ি পরতে পারে? অভিনয়ের পর এ প্রসঙ্গে অনুযোগ করাতে উনি মুখটা কুঁচকে বললেন, ‘‘সবাই পুজোতে ভাল ভাল জামাকাপড় করবে। আমার বাড়িতে মা রয়েছেন, ও রয়েছে। একটা লক্ষণ বলে তো কথা আছে।’’ বুঝলাম, ভুল জায়গায় আমি অভিযোগ জানিয়েছি। আর কথা বাড়ালাম না।
বুঝলাম, দুগ্গাপুজোর থিয়েটার আসলে শুধুই বিনোদন। ওতে কোনও লোকশিক্ষের ব্যাপার-স্যাপার নেই। খাওয়াদাওয়া-আড্ডার মতো এও নিছক এক বিনোদন। বলছি না যে এর কোনও ব্যতিক্রম নেই, তবে এ কথাও জোর দিয়ে বলতে পারি, ব্যতিক্রম যদি থাকেও, তা কোটিতে গুটিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy