E-Paper

নজর এড়াতে ‘হটলাইন’ ছেড়ে কারবার

মাদকের বড় চক্র নয়, এরা খুচরো কারবারি। নিজেরাই মাদক তৈরি করে, বেচেও। রাজ্যে প্রতিপক্ষ, রাজনীতি, পুলিশ, নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো সামলে কী ভাবে চলছে কারবার।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৫ ০৬:৫৪

—প্রতীকী চিত্র।

‘‘‘হট লাইন’-এ থাকার চাপ অনেক বেশি, চার দিকে বেইমানের দল। ও লাইনে মাল (টাকা) কম। নিজেদের ব্যবসায় ঝামেলা কম, মালও বেশি।’’ খৈনি ডলতে ডলতে বলছে চল্লিশোর্ধ্ব। নাম জানতে চাওয়ায় উত্তর এল, ‘‘রাজা লিখবেন।’’ ছবি না তোলার শর্তে জলপাইগুড়ি শহর থেকে প্রায় ছ’কিলোমিটার দূরে তার আসা, জাতীয় সড়কের ধারে কথা বলতে। জানাল, সম্প্রতি ‘হট লাইন’ ছেড়ে শুরু করেছে মাদকের কারবার। অংশীদারিতে। মাদক বানায় ‘সর্দার মাসি’। রাজার দায়িত্ব তা গ্রাহকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার।

‘হট লাইন’ মাদক ব্যবসার বড় ‘নেটওয়ার্ক’, যা একাধিক শহর-রাজ্য-দেশে বিস্তৃত। ‘বেইমান’ মাদক-নেটওয়ার্কে যুক্ত এমন কেউ, যে বা যারা টাকা বা অন্য সুবিধার বিনিময়ে মাদক পাচারের খবর যথাস্থানে দিয়ে দেয়। রাজার কথায়, “দু’বার ধরা পড়েছি। দু’বারই ডিলারের থেকে মাল কিনে ফেরার সময়ে। তা হলেই বুঝুন, খবর কী করে গেল!”

এমন ‘রাজা’ আরও আছে উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গে ছড়িয়ে। যারা সরাসরি কোন ‘মাদক কারবারি গোষ্ঠী’র (কার্টেল) সঙ্গে যুক্ত নয়। স্থানীয় ভাবে মাদকের কারবার করে। সম্প্রতি রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় তেমন লোকজনও ধরা পড়তে শুরু করেছে, যাতে বোঝা যাচ্ছে, তেমন খুচরো কারবারির সংখ্যা নেহাত কম নয়। রাজার দাবি, মাদক কারবারের কাঁচা টাকার ঝলক লোকের নজরে এসেই যায়, তবে ‘হট লাইন’-এ যুক্ত থাকলে পুলিশ, গোয়েন্দা, নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি)-র নজরে পড়ার সম্ভাবনা বেশি।

পলেস্তারাহীন ইটের পাকা বাড়ি। সামনে দাঁড় করানো নম্বরপ্লেটহীন লক্ষাধিক টাকার মোটরবাইক। মালদহের কালিয়াচকের মোজমপুরের ঢালাই রাস্তা থেকে পিচ রাস্তায় তীব্র শব্দে সে মোটরবাইক ছুটিয়ে চলে গেল বছর কুড়ির ছিপছিপে চেহারার যুবক। মোটরবাইকের গতি দেখে মোড়ের চায়ের দোকানে বসে থাকা এক প্রৌঢ় বলে ওঠেন, “হাতে এখন কাঁচা টাকা। মোটরবাইক তো ছুটবেই।” আর এক জন বলেন, “কিছুদিন আগেও চায়ের দোকানে কাজ করত। টাকার জন্য ভিন‌্ রাজ্যে এক বার গিয়েছিল। এখন কোথা থেকে টাকা আসছে, কে না জানে!’’ স্থানীয় সূত্রের খবর, মোজমপুর এলাকার কিছু যুবকের হাতে এখন কাঁচা টাকা আসছে, মাদক কারবার থেকে। তাদের কেউ সরাসরি মাদক বানানোয় যুক্ত, কেউ তা সরবরাহের কাজে। আর সে কারবারের প্রভাব পড়ছে অন্য জেলাতেও। এ রাজ্যের মাদক-মানচিত্রে কালিয়াচকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তা শুধু উৎপাদনের অন্যতম আঁতুড়ঘর হিসাবে নয়, কাঁচামাল আমদানির ‘ট্রানজ়িট পয়েন্ট’ হিসেবেও।

২০০২ সালের আগে-পিছে নদিয়ার তেহট্ট, পলাশিপাড়া, কালীগঞ্জ ও নাকাশিপাড়া এলাকায় শত-শত বিঘা জমিতে পোস্ত চাষ শুরু হয়েছিল। সেই পোস্তর আঠা ব্যবহার করেই কালীগঞ্জের বড় চাঁদঘর ও ছোট চাঁদঘরে দেশি প্রক্রিয়ায় হেরোইন তৈরি শুরু হয়। পুলিশ সমস্ত পোস্ত খেত নষ্ট করে। তবে মাদকের কারবারে লাগাম পড়েনি। পলাশিপাড়ার বড় নলদহ, ছোট নলদহ ও বাউড় এলাকায় মাদক তৈরির ‘শিল্প’ ছড়িয়ে পড়েছে। নদিয়ায় এই আঠা আসে মূলত ঝাড়খণ্ড, মণিপুর বা উত্তরপ্রদেশ থেকে, মালদহের কালিয়াচক হয়ে।

এলাকাবাসীর একাংশ জানাচ্ছেন, মোজমপুরের হারুচক বা ঢাবের মতো নানা গ্রামে জনবসতি থেকে দূরে ছড়ানো বাগানে গজিয়ে উঠেছে কারখানা। সেখানে পরিত্যক্ত ঘর বা অস্থায়ী আস্তানায় চলছে মাদক বানানো (কুকিং)। ‘ব্রাউন সুগার’ তৈরির প্রধান উপাদান পোস্তর আঠা। অসম, মণিপুর, মেঘালয়ের মতো রাজ্য থেকে শিলিগুড়ি হয়ে কিংবা ঝাড়খণ্ড থেকে মুর্শিদাবাদের ফরাক্কা হয়ে কালিয়াচক, বৈষ্ণবনগরে ঢুকছে সেই আঠা। পোস্তর আঠা কেজি প্রতি বিক্রি হয় প্রায় দেড় লক্ষ টাকা দামে।

মোজমপুরের এক কারবারির দাবি, “এক কেজি পোস্তর আঠা শুকিয়ে ৪০০-৪৫০ গ্রাম পাউডার বেরোয়। সে পাউডারের সঙ্গে এক হাজার টাকার বিনিময়ে কেনা কিছু রাসায়নিক, প্রতি লিটার পঞ্চাশ টাকা দরে কেনা ‘ডিস্টিল্ড ওয়াটার’ মাল (মাদক) বানাতে কাজে লাগে। প্রায় দশ গুণ মুনাফার আশা থাকে।” তবে শুধু রাসায়নিক কেনা নয়, মাদকের এই কুটিরশিল্পে খরচ আরও আছে।

(চলবে)

(তথ্য অনুসন্ধানে: অনির্বাণ রায়, সুস্মিত হালদার, নমিতেশ ঘোষ, সীমান্ত মৈত্র, অভিজিৎ সাহা, দয়াল সেনগুপ্ত, সামসুদ্দিন বিশ্বাস, নির্মল বসু, সামসুল হুদা, প্রসেনজিৎ সাহা, পীযূষ নন্দী, শুভঙ্কর পাল, সুশান্ত সরকার।)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Illegal drugs

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy