Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
বিড়ম্বনার চার অধ্যায়

দল ছেড়ে দিয়েছেন টুম্পাই, নেত্রী জানলেন টিভি দেখে

সারদা-কাণ্ডে জামিন পাওয়ার ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই তৃণমূল ছাড়ার ঘোষণা করে দিলেন সৃঞ্জয় বসু! দলের সদস্যপদ ছাড়ার পাশাপাশি রাজ্যসভার সাংসদ-পদে ইস্তফা দেওয়ার কথাও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। তৃণমূল ছেড়ে আপাতত অন্য কোনও দলে সৃঞ্জয় যোগ দেননি ঠিকই। প্রায় সন্ন্যাস নেওয়ার ঢঙে তাঁর উপলব্ধির কথা জানিয়ে বলেছেন, রাজনীতি তাঁর জন্য নয়! কিন্তু সংসদের আসন্ন বাজেট অধিবেশনের আগে সংসদীয় দলে ভাঙন কোণঠাসা তৃণমূলের কাছে নিঃসন্দেহে বড় ধাক্কা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩১
Share: Save:

সারদা-কাণ্ডে জামিন পাওয়ার ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই তৃণমূল ছাড়ার ঘোষণা করে দিলেন সৃঞ্জয় বসু! দলের সদস্যপদ ছাড়ার পাশাপাশি রাজ্যসভার সাংসদ-পদে ইস্তফা দেওয়ার কথাও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। তৃণমূল ছেড়ে আপাতত অন্য কোনও দলে সৃঞ্জয় যোগ দেননি ঠিকই। প্রায় সন্ন্যাস নেওয়ার ঢঙে তাঁর উপলব্ধির কথা জানিয়ে বলেছেন, রাজনীতি তাঁর জন্য নয়! কিন্তু সংসদের আসন্ন বাজেট অধিবেশনের আগে সংসদীয় দলে ভাঙন কোণঠাসা তৃণমূলের কাছে নিঃসন্দেহে বড় ধাক্কা।

তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, তাঁর ঘনিষ্ঠ টুম্পাইয়ের (সৃঞ্জয় বসুর ডাকনাম) দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত টিভি দেখে জেনেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁকে তিনি হাতে ধরে নিয়ে এসে দলের টিকিটে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছিলেন, তিনি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেন দলনেত্রীকে জানালেন না, তা নিয়ে বৃহস্পতিবার ঘনিষ্ঠ মহলে উষ্মাও প্রকাশ করেছেন তৃণমূল নেত্রী। তবে প্রকাশ্যে এই নিয়ে মুখ খোলেননি। দলের ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য দলের অন্দরে বলেছেন, দলনেত্রী তো বলেই দিয়েছেন, তৃণমূলে থাকতে হলে লড়াই করে যেতে হবে। যাঁরা লড়াই করতে জানবেন না, তাঁদের নিয়ে আর কী করা যাবে! তৃণমূলের একটি সূত্রের ব্যাখ্যা, সৃঞ্জয় যে আসলে রণে ভঙ্গ দিলেন, মমতার এই মনোভাবই দলের অন্দরে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর ভাইপো অভিষেক।

সৃঞ্জয় অবশ্য দল ছেড়ে দিলেও তৃণমূল বা শাসক দলের নেত্রীর সঙ্গে কোনও তিক্ততায় জড়াতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, এই মুহূর্ত থেকেই তিনি দলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করছেন। একই সঙ্গে জানিয়েছেন, রাজ্যসভার সাংসদ-পদও তিনি ছেড়ে দিতে চান। সে জন্য রাজ্যসভার নোটিস পাঠানো হয়েছে। তবে সাংসদ পদ ছাড়তে হলে স্পিকারের কাছে সশরীর হাজির হয়ে পদত্যাগপত্রে সই করতে হয়। ফলে, এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কিছুটা সময় লাগবে।

বিবৃতি দিয়ে সৃঞ্জয় আরও বলেছেন, “মমতাদি’র কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তিনি আমার উপরে আস্থা রেখেছিলেন, সুযোগ দিয়েছিলেন। কিছু দিন ধরে জেলে থাকতে থাকতে আমার মনে হয়েছে, রাজনীতি আমার জন্য নয়। বিশেষত, আমার মা এবং স্ত্রী বারবার এই ব্যাপারে চাপ দিচ্ছিলেন। তাই এই সিদ্ধান্ত।” সৃঞ্জয়ের এই বক্তব্য কার্যত লুফে নিয়েই কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি-র বিরুদ্ধে তাঁদের সাংসদের পরিবারের উপরে চাপ সৃষ্টির অভিযোগ এনেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন

সারদা রিয়েলটি মামলায় সিবিআইয়ের তরফে কিছু ‘গাফিলতি’র জন্য বুধবারই জামিন পেয়ে যান সৃঞ্জয়। তখনই জল্পনা শুরু হয়, তা হলে কি সৃঞ্জয়ের জন্য আপাত-স্বস্তির রাস্তা তৈরি করে দেওয়া হল? সিবিআইয়ের তরফে স্পষ্ট ভাবেই সেই জল্পনা খারিজ করা হয়েছিল। কিন্তু তার পর দিনই সৃঞ্জয়ের দল ছাড়ার ঘোষণা সেই জল্পনাকে আরও জোরালো আকারে ফিরিয়ে এনেছে! তাঁর ছেড়ে-আসা দলও পরপর দু’দিনের ঘটনার যোগসাজশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিচ্ছেদের মুহূর্তে সৃঞ্জয়কে আক্রমণ না-করে তৃণমূলের তরফে জানানো হয়েছে, দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত তাঁর ব্যক্তিগত। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ তাঁর আছে। তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেছেন, “আমরা কিছু দিন ধরেই বলছিলাম, কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল সৃঞ্জয়ের উপরে অসম্ভব চাপ সৃষ্টি করছিল। গত কাল তিনি জামিন পেয়েছেন। আর আজ (বৃহস্পতিবার) দল ছাড়লেন। চাপের ফলেই কি দুই ঘটনার মধ্যে কোনও সম্পর্ক থাকল?” একই সঙ্গে ডেরেকের মন্তব্য, “তবে আমরা খুশি তিনি মুক্তি (চাপ থেকে) পেলেন!” সৃঞ্জয়ের জায়গায় রাজ্যসভায় নতুন সাংসদ কে হবেন, তাঁর নামও শীঘ্রই জানিয়ে দেওয়া হবে বলে ডেরেক জানিয়েছেন।

তৃণমূল যাকে ‘চাপ সৃষ্টি’র ফল বলে অভিযোগ করছে, বিরোধীরা তাতেই আরও এক ধাপ এগিয়ে গড়াপেটার গন্ধ পাচ্ছে! সৃঞ্জয়ের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “৪০৯ ধারায় মামলা হলে কী করতে হয়, সব জানা সত্ত্বেও সিবিআই নতুন চার্জশিট দিল না! উনি জামিন পেলেন। আর তার পরেই দল ছেড়ে দিলেন! এর থেকেই তো প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকছে!” সৃঞ্জয়ের তৃণমূল-ত্যাগের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে এ দিনই বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ মন্তব্য করেছেন, “তৃণমূলের ফেরে পড়ে জেল খাটতে হল তাঁকে! যে পরিমাণ টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে ওঁর নামে, সেই টাকা তিনি অনায়াসে দান-খয়রাত করতে পারেন! তৃণমূলের মতো দলে ছিলেন বলেই ওঁর গায়ে অভিযোগের দাগ লেগেছে। চোরেদের সঙ্গ ছেড়ে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন সৃঞ্জয়।” বিজেপি নেতার এই মন্তব্যকেই হাতিয়ার করেছেন সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য সূর্যবাবু। তাঁর কথায়, “বিজেপি নেতাদের মন্তব্য থেকেও গোটা ঘটনাপর্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে!”

রাহুলবাবুরা যে ভাবে সৃঞ্জয়ের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছেন, সেই পথে যায়নি সিপিএম। সূর্যবাবুর বক্তব্য, সিবিআই তদন্ত হচ্ছে মানেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়নি এই কথা তাঁরা বারেবারেই বলেছেন। সৃঞ্জয়-পর্বের পরে নানা রকম সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি হল। আর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, “কেন সৃঞ্জয় রাজনীতিতে এলেন, কেনই বা গেলেন, তা তিনিই ভাল বলতে পারবেন! তবে সৃঞ্জয় নিরপরাধ, এ কথা বিশ্বাস করি না!” একই সঙ্গে তাঁর দাবি, “তৃণমূলে এই দল ছাড়ার মিছিল দীর্ঘতর হবে!”

রাজ্যসভার সাংসদদের সিবিআইয়ের মাধ্যমে কী ভাবে ‘নিশানা’ করা হচ্ছে, তা নিয়ে অভিযোগ জানাতে আজ, শুক্রবারই উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির কাছে দরবার করতে যাওয়ার কথা তৃণমূলের। তার আগের দিনই সৃঞ্জয়ের দলত্যাগ, অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়ের শিবির বদল এবং সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকার ও দলের তরফে করা মামলা খারিজ হয়ে যাওয়া এই তিন ধাক্কায় ফের বেসামাল অবস্থা তৃণমূলের অন্দরে! ঘরোয়া আলাপচারিতায় নানা চর্চা চলছে, শুরু হয়েছে দোষারোপের পালাও। কেন সৃঞ্জয়কে দলে নেওয়া হল এবং তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠানো হল, তা নিয়ে এত দিনের চেপে রাখা উষ্মা দলীয় আলোচনায় এ দিন বের করে এনেছেন অনেকেই। দলের প্রথম সারির এক নেতার কথায়, “আদতে সৃঞ্জয় এক জন ব্যবসায়ী। তাঁকে দিয়ে আমাদের বিরোধী অন্য সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকদের বিরুদ্ধে হয়তো দলনেত্রী লড়াই করাবেন ভেবেছিলেন! কিন্তু লাভ হল না!”

আবার দলের মধ্যেই অন্য শিবির থেকে বলা হচ্ছে, সারদা-কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়ার পরে তৃণমূল নেত্রী যে ভাবে মন্ত্রী মদন মিত্রের পাশে দাঁড়িয়েছেন, সৃঞ্জয়ের ক্ষেত্রে ঠিক সে রকম হয়নি। রাজ্যসভার ওই সাংসদের গ্রেফতারির পরে কলকাতার রাস্তায় ‘আমরা সবাই চোর’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে তৃণমূলের মিছিলে স্বয়ং মমতা হেঁটেছিলেন ঠিকই। কিন্তু সেই মিছিল শেষের সভাতেই আবার বলেছিলেন, ব্যক্তিগত ভাবে সৃঞ্জয়ের মতো কেউ কিছু করে থাকলে তাঁর কিছু বলার নেই! দলের মুখপাত্র হিসেবে ডেরেকও সেই ঘটনার পরে বলেছিলেন, সৃঞ্জয় গোড়া থেকে তৃণমূলের সৈনিক নন। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, ভদ্র পরিবারের সন্তান হিসেবে পরে তাঁর অন্তর্ভুক্তি (‘ল্যাটারাল এন্ট্রি’) ঘটেছিল। শাসক দলেরই এক সাংসদ বলছেন, “জেলে যাওয়ার পরে দলীয় মুখপত্রের সম্পাদক পদে সৃঞ্জয়কে সরিয়ে পার্থদা’কে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। দলনেত্রী ধরেই নিয়েছিলেন সৃঞ্জয়ের উপরে আর নির্ভর করা যাবে না!”

কী বলছেন পার্থবাবু? তৃণমূলের মহাসচিবের বক্তব্য, “সৃঞ্জয় জামিন পাওয়ায় আমরা খুশি। তবে পদত্যাগ একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। উনি খুবই অসুস্থ। ডেরেক যা বলার, বলেই দিয়েছেন। বোধহয় কোনও চাপে এ কাজ করেছেন।” বিজেপি-র চাপ? পার্থবাবুর জবাব, “সংবাদমাধ্যমের চাপও হতে পারে!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CBI Srinjay bose tmc saradha scam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE