Advertisement
E-Paper

শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসায় মাঝপথেই ছেদ, চলছে জড়িবুটি

সেরে উঠেও হারিয়ে যাচ্ছে ওরা। মাঝপথে চিকিৎসা থামিয়ে বা সেরে ওঠার পরে ‘ফলো-আপ’ চিকিৎসা না করিয়ে এ রাজ্যের শিশু ক্যানসার রোগীদের বড় অংশের জীবনে দাঁড়ি টানছেন পরিবারের লোকেরাই।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:২৬
রঙিন: ছবি আঁকছে ক্যানসার আক্রান্ত শিশু। নিজস্ব চিত্র

রঙিন: ছবি আঁকছে ক্যানসার আক্রান্ত শিশু। নিজস্ব চিত্র

সেরে উঠেও হারিয়ে যাচ্ছে ওরা। মাঝপথে চিকিৎসা থামিয়ে বা সেরে ওঠার পরে ‘ফলো-আপ’ চিকিৎসা না করিয়ে এ রাজ্যের শিশু ক্যানসার রোগীদের বড় অংশের জীবনে দাঁড়ি টানছেন পরিবারের লোকেরাই। একটি বেসরকারি সংস্থা ৫০০০ ক্যানসার আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে সম্প্রতি সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে, ৬০ শতাংশই প্রথম ধাপের চিকিৎসা শেষ করার পর ‘ফলো-আপ’ করেনি। তার পর অনেকেরই শরীরে ক্যানসার ফিরে এসেছে।

এই প্রবণতা দেখে সরকারি হস্তক্ষেপ চাইছেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের বক্তব্য, চিকিৎসা ও ‘ফলো আপ’ করলে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের ৭০ শতাংশই যে স্বাভাবিক আয়ু পেতে পারে, তার প্রচার চালাক সরকার। যদিও স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা জানান, এখনই এ নিয়ে তাঁদের ভাবনাচিন্তা নেই।

ঠাকুরপুকুরের একটি ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসক সোমা দে জানান, রক্তের ক্যানসারে ভুগছিল চার বছরের একটি শিশু। দীর্ঘ চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে ওঠে সে। ডাক্তাররা জানিয়ে দেন, বাড়ি ফিরে যেতে পারলেও নিয়মিত তাকে হাসপাতালে এসে ফলো-আপ করাতে হবে। বছর ঘুরে যায়। শিশুটি আর আসে না। হাসপাতালের তরফে বাড়িতে যাওয়া হলে বাবা-মা জানান, ছেলে তো ভাল হয়ে গেছে। এখন জলপড়া আর তাবিজ-কবচই যথেষ্ট! সোমার বক্তব্য, এমন নজির অজস্র। একে তো টাকা এবং লোকবলের অভাব। এ ছাড়াও পরিবার মনে করে, ফের চিকিৎসার জন্য গেলে সন্তানের লেখাপড়ার ক্ষতি হবে। বা ‘সুস্থ হওয়া’ সন্তান ফের হাসপাতালে গেলে ‘মানসিক ভাবে ভেঙে পড়বে’। এই অসচেতনতার মাসুল গোনে সন্তানেরা।

আরও পড়ুন: এই অপমান সহ্য হয় না, স্তন্যদান ছেড়ে শপিং মলে দুধের বোতলেই ভরসা

পরিসংখ্যান বলছে, গত সাত বছরে ঠাকুরপুকুরের একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ১৫৭৬টি শিশু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু ‘ফলো-আপ’-এ এসেছে মাত্র ৩২ জন। রাজারহাটের একটি ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সেখানেও মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দেয় অর্ধেকেরও বেশি শিশু। সরকারি হাসপাতালগুলিতেও ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ শিশু একবার বাড়ি গেলে আর ‘ফলো-আপ’-এর জন্য আসে না। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, শিশুদের কেমোথেরাপির কিছু দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকে। যেমন, ছ’বছর বয়সে কেমো নিলে ৩০ বছরে পৌঁছে কার্ডিওমায়োপ্যাথি ধরা পড়তে পারে। ফলে চিকিৎসকের কাছে নিয়মিত না গেলে বড় সমস্যা হতে পারে।

রাজারহাটের হাসপাতালে শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসক অর্পিতা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বছরে নতুন অন্তত ৫০০ রোগী চিকিৎসার জন্য আসে। তাঁদের মধ্যে একাংশ মাঝপথে চিকিৎসা থামিয়ে দেন। টাকার অভাব বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী। কখনও আবার লোকে বুদ্ধি দেয়, হোমিওপ্যাথি বা জড়িবুটি করো।’’ লিম্ফোমায় আক্রান্ত ১৪ বছরের এক কিশোরের কথা জানান অর্পিতা। চিকিৎসা করালে সে সুস্থ হয়ে উঠবে, এ সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত ছিলেন চিকিৎসকেরা। হঠাৎ সে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে আইসিইউ-য়ে পাঠানো জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু বাবা-মা জানান, আর খরচ করতে রাজি নন।

অর্পিতা বলেন, ‘‘আমরাই বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে চিকিৎসার জন্য টাকার ব্যবস্থা করি। তার পরেও বাবা-মা রাজি হচ্ছিলেন না। বহু চেষ্টায় রাজি করাই। ছেলেটি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ওকে যদি আমরা বাঁচাতে না পারতাম, তার দায় সমাজ তো অস্বীকার করতে পারত না।’’

পার্ক সার্কাসের ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এর চিকিৎসক দীপশিখা মাইতি বলেন, ‘‘লিউকেমিয়ার চিকিৎসার জন্য প্রায় আড়াই বছর লাগে। অতটা সময় হাসপাতালে ভর্তি রাখা যায় না। একটু ভাল হওয়ার পরে যখন সাময়িক ভাবে বাড়ি পাঠানো হয়, বাবা-মা ধরে নেন, সন্তান ভালই আছে। আবার ফেরত আসার দরকার নেই। কেমো নেওয়ার পরে সাময়িক শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে সেটাই বড় করে দেখে চিকিৎসা মাঝপথে বন্ধ করেন অনেকে।’’ ৫ বছরের ছেলেকে নিয়ে ঠাকুরপুকুরের হাসপাতালে আসতেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরের সুমালি সাঁতরা। গত ২ বছর ফলো-আপ করাননি। কেন? সুমালি বলেন, ‘‘ছেলেটা ভাল হয়ে গিয়েছে। এখন বিষ ওষুধ আর খাওয়াব না। পাড়ার লোকেরা বলেছে, ঠাকুরের থানে গেলেও সব ঠিক হয়ে যাবে।’’

ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এর অধিকর্তা অপূর্ব ঘোষ মনে করান, ক্যানসার আক্রান্ত শিশুর আরও সমস্যা থাকে। তার চুল পড়ে যায়, কথা বলার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। অবসাদে ভোগে। তাকে মূল স্রোতে ফেরানোর জন্য রিহ্যাব সেন্টার খুব জরুরি। জানুয়ারি মাসে সেখানেই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় চালু হতে চলেছে রাজ্যের প্রথম রিহ্যাব সেন্টার। ওই প্রকল্পের কর্ণধার তথা শিশু ক্যানসার রোগীদের নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করা পার্থ সরকার শুনিয়েছেন, প্রভাত বেনিয়া নামে ছ’বছরের একটি ছেলের পরিণতির কথা। নেফ্রোব্লাস্টিক ক্যানসারে আক্রান্ত ছিল প্রভাত। সুস্থ করার পরে বাড়ি ফেরানো হল তাকে। কিন্তু পন্ডিতিয়ার বস্তির বাসিন্দা শিশুটিকে এলাকায় থাকতে দেওয়া যাবে না বলে জানান প্রতিবেশীরা। তাঁদের দাবি, ক্যানসার নাকি ছোঁয়াচে। রাতভর মা আর ছেলের ঠাঁই হয় রাস্তায়। পর দিন ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে ফের হাসপাতালে ভর্তি হল সে। মারা গেল দিন কয়েক পর। পার্থবাবুর কথায়, ‘‘প্রভাতের মৃত্যু আমাদের হুঁশ ফিরিয়েছে। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আর নয়।’’

Cancer Treatment Children
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy