Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

আম চোরের বন্ধু! পিটিয়ে খুন ছাত্রকে

মাধ্যমিকে ছ’টা লেটার পেয়েছিলেন তিনি। অঙ্কে পেয়েছিলেন ১০০। এ বছরে উচ্চ মাধ্যমিকেও প্রথম বিভাগে পাশ। আশুতোষ কলেজে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য ফর্মও তোলা হয়ে গিয়েছিল।

অনিরুদ্ধ বিশ্বাস

অনিরুদ্ধ বিশ্বাস

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৬ ০৩:১৭
Share: Save:

মাধ্যমিকে ছ’টা লেটার পেয়েছিলেন তিনি। অঙ্কে পেয়েছিলেন ১০০। এ বছরে উচ্চ মাধ্যমিকেও প্রথম বিভাগে পাশ। আশুতোষ কলেজে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য ফর্মও তোলা হয়ে গিয়েছিল।

ঠাকুরপুকুরের সেই ১৮ বছরের মেধাবী অনিরুদ্ধ বিশ্বাস বেমক্কা গণপিটুনিতে খুন হয়ে গেলেন!

আম চুরিতে মদত দেওয়ার অভিযোগে শুক্রবার অনিরুদ্ধ ও তাঁর বন্ধু সুপ্রতিম বিশ্বাসকে বেধড়ক মারধর করেছিল দু’জন। তাদের এক জন, চিন্ময় সর্দারের দাবি ছিল, অনিরুদ্ধদের আরও দুই বন্ধু নাকি তার গাছ থেকে আম চুরি করেছে। বাড়িতে ঢিলও ছুড়েছে। তা নিয়ে খানিক চেঁচামেচির পর চিন্ময় ও তার সঙ্গী বিনোদ বাল্মীকি মদ্যপ অবস্থায় প্রায় পনেরো মিনিট ধরে দুই ছাত্রকে পেটায় বলে অভিযোগ।

সদ্য জন্ডিস থেকে ওঠা অনিরুদ্ধ সেই মারের ধকল নিতে পারেননি। শনিবারই ঠাকুরপুকুরের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয় তাঁকে। অবস্থার অবনতি হলে রবিবার অনিরুদ্ধকে সরানো হয় একবালপুরের বেসরকারি হাসপাতালে। মঙ্গলবার রাত দশটা নাগাদ সেখানেই মারা যান তিনি। অনিরুদ্ধর বাড়ির লোকেদের অভিযোগ, শুক্রবারই তাঁরা হরিদেবপুর থানায় গিয়েছিলেন। কিন্তু অভিযোগ নেওয়া হয়নি বলে অনিরুদ্ধর কাকা অভিজিৎ বিশ্বাস জানিয়েছেন। বুধবার অবশ্য চিন্ময় ও বিনোদকে গ্রেফতার করা হয়। এ দিন আদালতে তোলা হলে তাদের ১৩ জুন পর্যন্ত পুলিশ হেফাজত হয়েছে।

পুরো তিরিশ দিনও পেরোল না। চুরি সংক্রান্ত অপবাদের জেরে গণপিটুনিতে রাজ্যে খুন হয়ে গেলেন পরপর দু’জন ছাত্র। গত ৯ মে ডায়মন্ড হারবারের মন্দিরবাজারে ‘মোষ চোর’ অপবাদ দিয়ে মায়ের সামনেই পিটিয়ে মারা হয়েছিল বালিগঞ্জ আইটিআই-এর ছাত্র কৌশিক পুরকাইতকে। ওই ঘটনায় তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য তাপস মল্লিককে পরে গ্রেফতার করা হয়। শোনা গিয়েছিল, কৌশিককে যখন পেটানো হচ্ছিল, তখনও তাঁর মায়ের সঙ্গে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নিয়ে দরাদরি করছিল তাপস। গ্রামের সীমানা পেরিয়ে সেই নৃশংসতা এ বার উঠে এল খাস কলকাতা শহরে।

অনিরুদ্ধর বাড়ি ঠাকুরপুকুরের ক্যানসার হাসপাতালের পেছনে সত্যজিৎ পার্ক এলাকায়। পারিবারিক সূত্রে জানা গেল, জন্ডিস থেকে উঠে শুক্রবারই একটু সুস্থ বোধ করেছিলেন অনিরুদ্ধ। বিকেলে বেরিয়েছিলেন পাড়ার বন্ধু সুপ্রতিমের সঙ্গে। আশুতোষ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র সুপ্রতিম বুধবার জানান, অনিরুদ্ধর বাড়ি থেকে প্রায় ৩০০ মিটার দূরে ‘হরির বাগান’-এ একটি কুয়োর সামনে বসে তাঁরা দু’জনে গল্প করছিলেন। হঠাৎই দেখেন, দুই যুবক ছুটে আসছে। তাদের পেছনে তাড়া করে আসছে আর এক জন। পুলিশ জানিয়েছে, যে তাড়া করছিল, সে-ই চিন্ময় সর্দার।

সুপ্রতিমের বয়ান অনুযায়ী, তাড়া খাওয়া দুই যুবক তাদের সামনে দিয়েই দৌড়ে পালিয়ে যায়। তখন সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। ওই দু’জন পালিয়ে যাওয়ার পরে চিন্ময় ফিরে এসে তাঁকে ও অনিরুদ্ধকে জেরা শুরু করে। সে দাবি করে, তার বাড়ির গাছ থেকে আম চুরি গিয়েছে। এই সময়েই চিন্ময়ের সঙ্গে জুটে যায় বিনোদ। সুপ্রতিমের কথায়, ‘‘আচমকাই ওরা বলতে শুরু করল, যে দু’জন পালিয়ে গেল তারা নাকি আমাদেরই বন্ধু! আমাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দু’জনে মিলে আমাদের বেধড়ক মারধর করতে শুরু করে দেয়।’’

সুপ্রতিমের অভিযোগ, চিন্ময় ও বিনোদ দু’জনেই মদ্যপ অবস্থায় ছিল। টানা এলোপাথাড়ি মারধরের পর এক সময়ে তারা পালিয়ে যায়। একটু ধাতস্থ হয়ে বন্ধুর বাবা-মাকে ফোন করেন সুপ্রতিম। অনিরুদ্ধর বাবা বিশ্বজিৎ ও মা ঝর্ণা বিশ্বাস ঘটনাস্থলে এসে ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যান। রাতেই অনিরুদ্ধর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। পরের দিনই তাঁকে ভর্তি করতে হয় নার্সিংহোমে।

বেহালার আর্য বিদ্যামন্দিরের প্রাক্তন ছাত্র অনিরুদ্ধর বাড়িতে এ দিন ভিড় করা পাড়ার বাসিন্দাদের মুখে একটাই কথা, ‘‘বরাবরের মেধাবী ছেলে। ও কখনও চুরি করতে পারে?’’ অনিরুদ্ধর মাসি সীমা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, রাত থেকেই একটি ঘরে একা রয়েছেন অনিরুদ্ধর মা। কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন না।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চিন্ময় ইএসআই-এর কর্মী। বিনোদ কাজ করে একটি ওষুধের দোকানে। এ দিন চিন্ময়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনও আমগাছই নেই! পাশের বাড়িতে একটি আমগাছ অবশ্য রয়েছে। শুক্রবার সন্ধেয় সেই গাছেই কেউ ঢিল ছুড়েছিল বলে চিন্ময়ের দাবি। কিন্তু সেটা কী করে ‘তার’ গাছ হল, সদুত্তর মেলেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Student Madhyamik Mango
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE