Advertisement
০৭ মে ২০২৪
Sukanta Majumdar

হাজরা থেকে বসিরহাট, ‘নেতা’ থেকে ‘জঙ্গি নেতা’য় উত্তরণ সুকান্তের, তৃণমূল বলছে, লড়াই শুভেন্দুর সঙ্গে!

একদা এবিভিপি করতেন সুকান্ত। তার পরে অধ্যাপনা করতেন। ২০১৯ সালে সেই সুকান্তকে বালুরঘাটে প্রার্থী করে বিজেপি। জিতে সাংসদ হন তিনি। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব পান।

Sukanta Majumder\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\'s movement showed a militant mood for two consecutive days in Basirhat

সুকান্ত মজুমদার। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৯:১৩
Share: Save:

দু’পয়সা ট্রামভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে পঞ্চাশের দশকে কলকাতাকে অগ্নিগর্ভ করেছিল বামেরা। আবার সেই বামেরা সরকারে থাকার সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাইয়ের আন্দোলন, সিঙ্গুর-পর্বে তৃণমূলের বিধানসভা ভাঙচুর বাংলার রাজনীতিতে ‘মাইলফলক’ হয়ে রয়েছে। যা থেকে সাধারণ্যে একটি ধারণা রয়েছে যে, বিরোধীদলের আন্দোলন হবে আগ্রাসী, আমিষ। বিরোধী রাজনীতির ‘হাতিয়ার’ হবে গোলমাল, বিক্ষোভ, অবস্থান। রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে সেই ‘অবতারে’ বিশেষ দেখা যায় না। তবে মঙ্গল এবং বুধবার বসিরহাটে সুকান্তের মেজাজ এবং নাছোড়বান্দা মনোভাব তাঁকে ‘নেতা’ থেকে ‘জঙ্গি নেতা’য় উত্তীর্ণ করেছে বলে মনে করছেন রাজ্য বিজেপির প্রথম সারির নেতারা।

রাজ্যের শাসক তৃণমূল অবশ্য বলছে, সুকান্তের লড়াই আসলে শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে। জঙ্গি আন্দোলন করে তিনি নিজেকে বিরোধী দলনেতার তুলনায় বেশি ‘প্রাসঙ্গিক’ করতে চাইছেন। তৃণমূলের মুখপাত্র তথা অন্যতম রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘বিজেপি প্রযোজিত নট্ট কোম্পানির নাটক চলছে। শুভেন্দু না সুকান্ত— কে বড় অভিনেতা তার প্রতিযোগিতা চলছে! সুকান্ত দেখছেন, শুভেন্দু সব আলো শুষে নিচ্ছেন। তাই তাঁকেও কিছু করে দেখাতে হবে। এ সব কোনও আন্দোলনই নয়।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সুকান্তের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছেন। কিন্তু পাশাপাশিই বলেছেন, ‘‘এসব নাটক!’’ পাশাপাশিই সেলিমের প্রশ্ন, ‘‘ওদের নেতাগুলো এত নাদুসনুদুস কেন? গাড়ির বনেটে উঠতেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে? আমি আরোগ্য কামনা করছি। কিন্তু বিজেপির নেতারাও এসব দেখে আড়ালে মুখ টিপে হাসছেন!’’

বিজেপির এক প্রথম সারির নেতা অবশ্য বলেন, ‘‘সুকান্ত রাজনীতিতে নতুন। অচেনা পিচে খেলতে হচ্ছে। বুঝতে একটু সময় লাগছিল। তবে আস্তে আস্তে তিনি বুঝতে পারছেন, কোন বল কী ভাবে খেলতে হয়।’’

এর আগে সুকান্তকে এমন ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল ২০২২ সালের জুলাই মাসের শেষদিকে। রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি, তাঁর-ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের জোড়া ফ্ল্যাট থেকে পাহাড়প্রমাণ টাকা উদ্ধারের পর হাজরায় বিক্ষোভ সমাবেশ ডেকেছিল বিজেপি। সেই সমাবেশ থেকে আচমকাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির দিকে চলে গিয়েছিলেন সুকান্ত। কালবিলম্ব না-করে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। দিনভর লালবাজারের সেন্ট্রাল লক আপে কাটানোর পরে সন্ধ্যায় জামিন পেয়ে কর্মী-সমর্থকদের স্লোগান এবং রজনীগন্ধার মালায় ভূষিত হয়ে লালবাজার থেকে মুরলীধর সেন লেনের বিজেপি দফতরে গিয়েছিলেন রাজ্য সভাপতি। অনেকেই মনে করেন, সেই দিন সুকান্ত নিছক এক সাংসদ থেকে ‘নেতা’র স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন।

তবে মঙ্গল এবং বুধবার বসিরহাটে সুকান্ত যা করেছেন, তাতে যেমন নাটকীয়তা ছিল, তেমনই ছিল জঙ্গি মেজাজ। অসুস্থ হয়ে পড়ে শেষমেশ তাঁকে অ্যাম্বুল্যান্স-বাহিত হয়ে কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে ফিরতে হয়েছে বটে। কিন্তু পেশায় অধ্যাপক সুকান্তের ‘আন্দোলনমুখী’ ভাবমূর্তিটিও তৈরি হয়ে গিয়েছে।

একদা আরএসএস করতেন সুকান্ত। তার পরে অধ্যাপনা করতেন। ২০১৯ সালে রাজনীতিতে খানিক ‘আনকোরা’ সেই সুকান্তকে বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করে বিজেপি। জিতে সাংসদ হন সুকান্ত। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে পদ্মশিবিরের ভরাডুবির পর দিলীপ ঘোষের জায়গায় সুকান্তকে আনেন অমিত শাহ, জগৎপ্রকাশ নড্ডারা। সেই সময়ে বিজেপির অনেক সক্রিয় কর্মীও জানতেন না, কে সুকান্ত, কী তাঁর রাজনৈতিক ইতিহাস? সেই অর্থে কিছু ছিলও না। রাজনৈতিক মহলের অনেকের এ-ও বক্তব্য, সভাপতি হলেও সুকান্তের কখনও বঙ্গ বিজেপির ‘মুখ’ হয়ে ওঠা হয়ে ওঠেনি। কারণ, অধিকাংশ সময়ে তাঁকে শুভেন্দুর ছায়ায় ঢাকা পড়ে থাকতে হয়।

তবে খুচখাচ ‘আন্দোলন’ যে সুকান্ত করেননি, তা নয়। হাজরার ঘটনার আগে সুকান্ত ২০২২ সালের জুনে ‘অগ্নিগর্ভ’ উলুবেড়িয়ায় যাওয়ার ঘোষণা করে পুলিশি বাধা পেয়েছিলেন। তখন বিজেপির মনোভাব ছিল, পুলিশকে আগাম সফরের কথা জানিয়ে রাখলে বাধা দেবেই। সেই বাধা পাওয়ার বিষয়টি জনসমক্ষে এলে দলের ‘রাজনৈতিক লাভ’ হবে। কিন্তু বিরোধী রাজনীতির অঙ্গ পুলিশকে নাজেহাল করা বা তাঁদের চোখে ধুলো দেওয়াও। সম্ভবত সেই কারণেই সুকান্ত মঙ্গলবার লোকাল ট্রেনে চেপে বসিরহাটে রওনা হয়েছিলেন। কারণ, তার আগের দিনই সড়কপথে সন্দেশখালি যেতে গিয়ে কলকাতার চৌহদ্দির মধ্যেই পুলিশি বাধায় থামতে হয়েছিল শুভেন্দু এবং তাঁর সহকর্মী বিধায়কদের। ট্রেনে করে বসিরহাট পৌঁছতে সুকান্তদের বেগ পেতে হয়নি। তার পরে মঙ্গলবার দিনভর পুলিশ সুপারের দফতর অভিযানে সন্ধ্যা পর্যন্ত খণ্ডযুদ্ধ চলে। বসিরহাটের রাস্তায় বসে পড়েছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি। গভীর রাতে তাঁদের আটক করে পুলিশ। কিছুক্ষণ পরে ছেড়েও দেওয়া হয় তাঁদের।

রাতে টাকির হোটেলে থেকে যান সুকান্ত। গভীর রাত পর্যন্ত নাওয়াখাওয়া ছেড়ে বুধবারের আন্দোলনের পরিকল্পনা করেন। বুধবার সুকান্ত যেতে চেয়েছিলেন সন্দেশখালি। কিন্তু হোটেলের বাইরেই তাঁকে আটকে দেয় পুলিশ। তার পরে অবশ্য পুলিশের চোখে ধুলো দিয়েই কোলে সরস্বতী প্রতিমা নিয়ে ইছামতী নদীর ধারে চলে যান উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক সুকান্ত। সেখানেই বাগ্‌দেবীর আরাধনা সারেন।

পুজো মিটতেই শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে সংঘাত। কারণ, পুলিশ তাঁকে সন্দেশখালি যেতে দিতে চায়নি। তখনই আচমকা পুলিশের গাড়ির বনেটে উঠে পড়েন সুকান্ত। সেখানে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকেন তিনি। পাশাপাশিই সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নেরও জবাব দিচ্ছিলেন। তাঁকে ঘিরে রেখেছিলেন রাজ্যপুলিশের দুই সদস্য। আচমকাই এক মহিলা ওই দুই পুলিশকর্মীকে ধাক্কা মেরে গাড়ির বনেট থেকে ফেলে দেন। তার পরে তিনিই সুকান্তের হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান মেরে তাঁকে গাড়ির বনেটের উপর শুইয়ে দেন। চালমাটাল সুকান্তকে কোলে করে উদ্ধার করেন তাঁর নিরাপত্তরক্ষী।

তার পরেই সুকান্ত পিচরাস্তায় শুয়ে পড়েন। বিজেপির তরফে বলা হয়, তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েছেন। এর পরেই সুকান্তকে বসিরহাট মহকুমা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। গোটা বিষয়টির মধ্যে এক ধরনের আকস্মিকতা ও নাটকীয়তা ছিল। সাধারণত বিরোধী শিবিরের প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে যেমন হয়ে থাকে।

অসুস্থ সুকান্তকে বসিরহাটে না রেখে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সুকান্তের সঙ্গেই ছিলেন রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘এই (বসিরহাট) হাসপাতালে সুপারও নেই, স্পেশালিটিও নেই। যে রাজ্যের সরকারি হাসপাতাল মুখ্যমন্ত্রীর পায়ের ভুল চিকিৎসা করে, সেখানে অসুস্থ কাউকে রাখার ঝুঁকি নেওয়া যায় না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE