Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

অন্তর্দ্বন্দ্বে সুন্দরবন রক্ষার প্রকল্প নোনা জলের তলায়

নিজেদের উপকূল বাঁচাতে তৎপর গুজরাত-ওড়িশা। কিন্তু ম্যানগ্রোভের বৈভব নিয়ে যে-সুন্দরবন সামুদ্রিক ঝড়ঝঞ্ঝার বিরুদ্ধে বঙ্গভূমির প্রাকৃতিক প্রাচীর হয়ে আবহমান কাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে বাঁচাতে হুঁশ নেই পশ্চিমবঙ্গের! আয়লার তাণ্ডবের পরেও! এই উদাসীনতার পরিণাম ভয়ঙ্কর হতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা। তাঁরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে বড় ঘূর্ণিঝড় হলে ফের বিপর্যস্ত হবে সুন্দরবন। এবং সেই ক্ষতি দেগে দিয়ে যেতে পারে চিরস্থায়ী ক্ষতও!

এই কি ভবিতব্য সুন্দরবনের?  ফাইল চিত্র

এই কি ভবিতব্য সুন্দরবনের? ফাইল চিত্র

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৫
Share: Save:

নিজেদের উপকূল বাঁচাতে তৎপর গুজরাত-ওড়িশা। কিন্তু ম্যানগ্রোভের বৈভব নিয়ে যে-সুন্দরবন সামুদ্রিক ঝড়ঝঞ্ঝার বিরুদ্ধে বঙ্গভূমির প্রাকৃতিক প্রাচীর হয়ে আবহমান কাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে বাঁচাতে হুঁশ নেই পশ্চিমবঙ্গের! আয়লার তাণ্ডবের পরেও! এই উদাসীনতার পরিণাম ভয়ঙ্কর হতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা। তাঁরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে বড় ঘূর্ণিঝড় হলে ফের বিপর্যস্ত হবে সুন্দরবন। এবং সেই ক্ষতি দেগে দিয়ে যেতে পারে চিরস্থায়ী ক্ষতও!

বিশ্ব উষ্ণায়ন-সহ নানা কারণে পরিবেশের বদল ঘটছে। তার জেরে বিপন্ন হয়ে পড়ছে উপকূল এবং সেই এলাকার গাছ ও প্রাণিকুল। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন উপকূল অঞ্চলের বাসিন্দারাও। সেই সামগ্রিক ক্ষতির মোকাবিলায় তিন বছর আগে উপকূল রক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাঙ্কের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিল গুজরাত-ওড়িশা-বাংলা। ঠিক ছিল, চার বছরের মধ্যে উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষায় একটি সুংসহত প্রকল্প রূপায়ণ করা হবে। চার বছরের সময়সীমার মধ্যে তিন বছর কেটে যাওয়ার পরে গুজরাত-ওড়িশা সেই প্রকল্পে ভাল নম্বর পেয়ে পাশ করেছে। “পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু পিছনের সারিতেই,” বলছেন রাজ্যের পরিবেশ দফতরেরই এক শীর্ষ কর্তা। এবং একই সুরে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টেও।

গত ফেব্রুয়ারিতে এই প্রকল্পের সর্বশেষ রিপোর্টে বিশ্বব্যাঙ্ক বলেছে, ওড়িশা-গুজরাতে প্রকল্পটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। গুজরাতে কাজের সুফল মিলতে শুরুও করেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ২০১৩ সাল থেকেই প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ রাজ্যে প্রকল্পের অনেক কাজ সময়ে শেষ হবে না বলে বিশ্বব্যাঙ্কের আশঙ্কা।

বাংলায় এই হতশ্রী অবস্থা কেন?

পরিবেশ দফতরের বিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন, উপকূল সুসংহত প্রকল্প রূপায়ণ তো দূরের কথা, উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষায় প্রাথমিক গবেষণার যন্ত্রপাতিই কেনা হয়নি। নানা কারণ দেখিয়ে দফতরের অফিসারদের একাংশ প্রকল্প রূপায়ণে বাধা দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ। ওই দফতর সূত্রের খবর, সরঞ্জাম কেনার পরিকল্পনা প্রায় বাতিলই করে দেওয়া হয়েছে। যন্ত্র খাতে বিশ্বব্যাঙ্কের দেওয়া চার কোটি টাকাও খরচ করতে পারেননি প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা অফিসারেরা। অথচ উপকূল রক্ষায় চিরস্থায়ী পরিকল্পনা রূপায়ণে ওই সব যন্ত্রপাতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

কেন?

রাজ্যের উপকূল পর্ষদের এক প্রাক্তন বিজ্ঞানী জানাচ্ছেন, উপকূল রক্ষায় সমুদ্রতলের উচ্চতা, নদীর গতিপথ বদল এবং স্থানীয় জলবায়ু পরিবর্তন-সহ বিভিন্ন বিষয়ে সমীক্ষা করতে হয়। উপকূল বাঁচাতে কী কী দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা ঠিক করতে এই সমীক্ষা একান্ত প্রয়োজন। পরিবেশ দফতরের এক কর্তা বলেন, প্রকল্পের অন্যতম শর্ত ছিল, তথ্য ও জ্ঞান ভাণ্ডার তৈরি করা। কারণ, স্থানীয় ভাবে কতটা পরিবর্তন ঘটছে, তা না-জানলে উপকূল রক্ষায় নিজস্ব পদক্ষেপ করাই সম্ভব নয়। আর সেই কাজের জন্য চাই যন্ত্রপাতি।

কী কী যন্ত্রপাতি প্রয়োজন?

পরিবেশ দফতরের খবর, ক্লাইমেট প্রোফাইলার এবং টাইড গজ নামে দু’টি যন্ত্র বসানোর কথা ছিল। ক্লাইমেট প্রোফাইলারের সাহায্যে সংশ্লিষ্ট এলাকার তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহের গতির মতো আবহাওয়া সংক্রান্ত জরুরি তথ্য সংগ্রহ ও পরিমাপ করা হয়। আর জোয়ার-ভাটায় সমুদ্র ও নদনদীর জলস্তরের হ্রাসবৃদ্ধির উপরে নজর রাখে টাইড গজ। এই সব সরঞ্জাম নিয়ে উপকূল রক্ষায় ছোটখাটো একটা হাওয়া অফিস গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়াও নদীর গতিপথ নিয়ে সবিস্তার সমীক্ষা করার দরকার ছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক তুহিন ঘোষের বক্তব্য, উপকূল রক্ষায় আবহাওয়া-জলবায়ুর উপরে টানা নজরদারি এবং জোয়ারের সময় জলের উচ্চতা পরিমাপ না-করলে দীর্ঘস্থায়ী কোনও ব্যবস্থা করা যাবে না। “সুন্দরবনে সত্যিই বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব পড়ছে কি না, তা বুঝতে গেলে ওই এলাকার জলবায়ু ও জলস্তরের তথ্য দরকার,” বলছেন তুহিনবাবু।

কিন্তু সুন্দরবন এলাকায় জলস্তর বাড়ছে না কমছে, তার কোনও তথ্য যে রাজ্যের হাতে নেই, পরিবেশ দফতর সূত্রে তা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে যে-তথ্য রয়েছে, তা থেকেই এখানে কাজ চালানো হয়। কিন্তু রাজ্যের এক বিজ্ঞানী বলছেন, “বাংলাদেশের সুন্দরবন এবং এ দেশের সুন্দরবনের মধ্যে ভূপ্রকৃতিগত ফারাক আছে। তাই জলস্তর বৃদ্ধিও এক রকম হবে না।” অর্থাৎ বাংলাদেশি তথ্যের ভিত্তিতে কাজ চালানো ভস্মে ঘি ঢালারই সামিল। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মোহনার কাছে নদীর গতিপথে নানান বদল ঘটে। তাতে উপকূল এলাকার বিভিন্ন দ্বীপ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উপকূলকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে নদীর গতিপথ নিয়েও সবিস্তার সমীক্ষা প্রয়োজন।

উপকূল রক্ষায় এ রাজ্যের তেমন নজর নেই কেন?

এর জন্য আমলাদের একাংশের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং পরিকল্পনার অভাবকেই দায়ী করছেন পরিবেশ দফতর ও রাজ্যের বিজ্ঞানীরা। পরিবেশ দফতর সূত্রের খবর, উপকূল পরিচালন প্রকল্পের গোড়ার দিকে আমলা ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে একটা সমন্বয় ছিল। তার জোরেই কাজ কিছুটা গতি পেয়েছিল। কিন্তু ২০১৩-র গোড়া থেকেই প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে। তার অন্যতম কারণ, যে-সব বিজ্ঞানী এই কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছিলেন, মাঝপথে তাঁদের অনেককেই সরিয়ে দেওয়া হয়। পরিবেশ দফতরের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো গোলমাল নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন অফিসারেরা। ফলে প্রকল্প রূপায়ণের কাজ থমকে গিয়েছে। তাই বারবার বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে সমালোচনা শুনতে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গকে।

প্রকল্প মুখ খুবড়ে পড়েছে, এটা মানতে রাজি নন পশ্চিমবঙ্গে উপকূল পরিচালন প্রকল্পের অধিকর্তা সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “প্রকল্পের কাজ খুব ভাল চলছে। কতটা ভাল চলছে, সংবাদমাধ্যমের কাছে তার কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই।” আর উপকূলের জলবায়ু ও জলতল মাপার যন্ত্রপাতি কেনার কোনও প্রয়োজন নেই বলেই মনে করেন তিনি!

প্রকল্পের অধিকর্তা যা-ই বলুন, প্রমাদ গুনছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, বঙ্গোপসাগর ক্রমশ ঘূর্ণিঝড়প্রবণ হয়ে পড়ছে। গত বছরই পরপর চারটে ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল বঙ্গোপসাগরে। তার মধ্যে পিলিন ছিল অতি-প্রবল ঘূর্ণিঝড়। “বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় বাড়লে বিপন্ন হয়ে পড়বে সুন্দরবন। আর সুন্দরবন বিপন্ন মানে দক্ষিণবঙ্গই বিপন্ন,” মন্তব্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা বিভাগের এক শিক্ষকের।

বহিঃশত্রুর হামলা থেকে সমুদ্রসীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব উপকূল রক্ষী বাহিনীর। কিন্তু প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা থেকে উপকূল বাঁচানোর যে-দায় রাজ্যের, প্রশাসন সেই ব্যাপারে কেন উদাসীন থাকবে, প্রশ্ন বিজ্ঞানীদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE