Advertisement
E-Paper

বাম-বসন্তের স্মৃতি উস্কে পদ্মেও ‘বেঙ্গল লাইন’! শুভেন্দু-মন্তব্যের দায় নিচ্ছে দিল্লিও, সিলমোহর পশ্চিমবঙ্গের ‘নিজস্ব উদ্বেগ’ তত্ত্বে

এ রাজ‍্যে বাম রাজনীতির ভরা বসন্তে ‘বেঙ্গল লাইন’, ‘কেরল লাইন’ গোছের শব্দবন্ধ আকছার শোনা যেত। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সিপিএমের চালচলন কেমন হবে, তা নিয়ে বাংলা আর কেরলের নেতৃত্বের মধ্যে টানাপড়েনে বিবিধ লাইনের জন্ম।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৫ ১২:০০
suvendu adhikari

শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।

আচমকা মন্তব্যে ‘অস্বস্তি’ যে তৈরি হয়েছিল, সে কথা প্রকাশ্যে কেউই মানতে চাইছেন না। কিন্তু বিজেপির ‘কৌশলী’ অবস্থান বলছে, অস্বস্তি একটা তৈরি হয়েছিল। তা কাটানোর কৌশল হিসাবে সামনে আসছে ‘বেঙ্গল লাইন’। শুভেন্দু অধিকারীর কাশ্মীর-মন্তব্যকে সমর্থন করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ নীতিকে বিজেপি লঘু করছে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিত’ মাথায় রেখে শুভেন্দুর মন্তব্যের দায় এড়ানোর চেষ্টাও করছে না। এই দুই মেরুর মাঝে সেতু হয়ে দাঁড়াচ্ছে ‘বেঙ্গল লাইন’।

এ রাজ‍্যে বাম রাজনীতির ভরা বসন্তে ‘বেঙ্গল লাইন’, ‘কেরল লাইন’ গোছের শব্দবন্ধ আকছার শোনা যেত। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সিপিএমের চালচলন কেমন হবে, তা নিয়ে বাংলা আর কেরলের নেতৃত্বের মধ্যে টানাপড়েনে বিবিধ লাইনের জন্ম। বঙ্গে সিপিএম ধূলিসাৎ হওয়ার পর থেকে ‘বেঙ্গল লাইন’-এর গুরুত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে। সিপিএমের দখলে থাকা একমাত্র রাজ্য কেরলের মতামতই এখন দলে গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপি-তে তেমন কোনও ‘উত্তরপ্রদেশ লাইন’ বা ‘গুজরাত লাইন’ এখনও নেই। বরং কখনও-সখনও নীতিগত টানাপড়েনে ‘নাগপুর লাইন’ এবং ‘দিল্লি লাইন’-এর মতপার্থক্য আলোচিত হয়। কিন্তু পহেলগাঁও হামলার ভয়াবহতা ভুলে পর্যটকদের আবার কাশ্মীর যাওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে আচমকা তৈরি বিতর্কে বিজেপি-কে এখন ‘বেঙ্গল লাইন’ সামনে আনতে হচ্ছে। দলের তরফে কেউ ‘বেঙ্গল লাইন’ শব্দবন্ধ ব‍্যবহার করছেন না ঠিকই, কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, রাজ্য নেতৃত্ব, পরিষদীয় দল— সকলের মুখে এখন ‘বাংলার পরিস্থিতি’র দোহাই। বিজেপি বোঝাতে চাইছে, মতবিরোধের কারণে এই ‘বাংলা লাইন’ নয়, বরং বাংলার পরিস্থিতি আলাদা ভাবে বিশ্লেষণ করার বিষয়ে দলে ‘মতৈক্য’ রয়েছে।

পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলার পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, জম্মু-কাশ্মীরের অগ্রগতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে পাকিস্তান ওই হামলা করিয়েছিল। পাকিস্তানের সেই উদ্দেশ্য সফল হতে না দেওয়ার আহ্বানও মোদীর মুখে একাধিক বার শোনা গিয়েছে। তাঁর ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ, সব কা বিশ্বাস’ নীতি থেকে কাশ্মীর বাদ পড়েনি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর সাম্প্রতিক মন্তব্য সে নীতি থেকে দূরে। গত বৃহস্পতিবার জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকের পরে আর্জি জানান, বাংলা থেকে পর্যটকেরা আবার যেন কাশ্মীর যান। তার প্রেক্ষিতেই শুভেন্দুর আহ্বান ছিল, কেউ কাশ্মীর যাবেন না, আগে নিজের প্রাণ বাঁচান।

শুভেন্দুর ওই মন্তব্যে রাজ‍্য রাজনীতিতে আলোড়ন ওঠে। তৃণমূল শুভেন্দুর মন্তব্যের নিন্দা করে। বঙ্গের বিরোধী দলনেতা কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত নীতির বিরোধিতা করছেন কি না, সে প্রশ্নও তোলা হয়। রাজ‍্য বিজেপির নতুন সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যের অবস্থানও জানতে চায় তৃণমূল। বিজেপি প্রথমে ওই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দেয়নি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে যাঁরা বাংলার দায়িত্বে, তাঁরা নীরব ছিলেন। রাজ‍্য নেতারাও জবাব এড়াচ্ছিলেন। শুধু দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কী অবস্থান নেয় দেখুন।’’

বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবস্থান নিয়ে ফেলেছেন। সেই অবস্থান হল, দলের ভিতরে যা-ই চলুক, প্রকাশ্যে শুভেন্দুর মন্তব্যের বিরোধিতা করা হবে না।

গত শনিবার রাজ্য সভাপতি শমীক বিরোধী দলনেতার মন্তব্যের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘’শুভেন্দু অধিকারী নিজেই বলেছেন, এটা তাঁর ব‍্যক্তিগত মত।’’ কিন্তু তার সঙ্গেই শমীক যোগ করেন, ‘’বিরোধী দলনেতা হিসাবে শুভেন্দুবাবুকে রাজ‍্যের নানা প্রান্তে ঘুরতে হয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে যেতে হয়। তাঁদের আবেগ, অনুভূতি এবং মানসিকতার প্রতিফলন বিরোধী দলনেতার কণ্ঠস্বরে উঠে আসে।’’

বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও প্রায় এই ‘লাইনে’ই কথা বলতে শুরু করেছেন। প্রকাশ্যে সরাসরি মন্তব্য করতে তাঁরা এখনও রাজি নন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটি সূত্রের ব্যাখ্যা, ‘’পশ্চিমবঙ্গের যা পরিস্থিতি, তাতে এ রাজ‍্যের মানুষের মনে কাশ্মীর নিয়ে উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক। কাশ্মীরে যা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তের ও পারেই এখন তা প্রতি দিন ঘটছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকাতেও সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রাজ‍্যের এই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে শুভেন্দু অধিকারী ঠিকই বলেছেন। দল এ বিষয়ে একমত।’’ নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, ‘’পহেলগাঁও হামলায় পশ্চিমবঙ্গের কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা-ও ভাবতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের ক’জন বাসিন্দাকে ধর্ম জিজ্ঞাসা করে খুন করা হয়েছে, তা ভুলে গেলে চলবে না। বাংলাদেশে কী হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দেখছেন। পশ্চিমবঙ্গে কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ খুব স্বাভাবিক।’’

একই সুর উঠছে বিজেপি পরিষদীয় দল থেকেও। অধিকাংশ বিধায়ক প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। কিন্তু বলছেন, শুভেন্দু ‘অন‍্যায়’ কিছু বলেননি। বিরোধী দলের মুখ‍্য সচেতক শঙ্কর ঘোষের কথায়, ‘‘শুভেন্দুবাবুর মন্তব্যে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে সেই আলোচনা জরুরি।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘কে কোথায় বেড়াতে যাবেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। শুভেন্দুবাবু তো কারও টিকিট কেটে দেবেন না বা কেউ টিকিট কাটলে আটকাতেও যাবেন না। কিন্তু কাশ্মীরের পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন‍্য অত‍্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ থাকাও স্বাভাবিক। এই নিয়ে আলোচনাটা যে শুরু হয়েছে, আমাদের মতে সেটাই ইতিবাচক।’’

শুভেন্দুর ওই মন্তব্য নিয়ে যে ভাবে দলের অন্দরে একই সুরে বলছে বিজেপি, তাকে অনেকেই ‘কৌশলী অবস্থান’ হিসাবে দেখছেন। আলোচনার ভিত্তিতে ‘লাইন’ নির্ধারিত না হলে প্রায় সমস্ত পক্ষের তরফে এমন ‘যমজ বয়ান’ মেলা কঠিন। শুভেন্দুর কাশ্মীর-মন্তব্যের প্রেক্ষিতে দলের ‘লাইন’ নির্ধারণের প্রশ্নে আলাদা করে কোনও বৈঠক হওয়ার খবর অবশ্য নেই। কিন্তু রাজ‍্য কর্মসমিতির এক সদস‍্যের কথায়, ‘’সমন্বয় মসৃণ থাকলে সব সময় বৈঠক ডেকে লাইন নির্ধারণের প্রয়োজন পড়ে না।’’

Suvendu Adhikari Pahalgam Terror Attack Omar Abdullah Mamata Banerjee Terrorism BJP Bengal Line West Bengal Politics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy