এক মাছের অনেক স্বাদ, নাম তার রাইখর। রান্নার রসনায় মনে থাকে সারা বছর—এক দুই নয়, রীতিমতো সাত আট রকম ভাবে রাইখর মাছ রান্না করে ভিন্ন স্বাদের রসনা তুলে দেওয়ার মা ঠাকুর্মার আমল এখন আর নেই। তবে চার-পাঁচ রকমের রান্না পদ বালুরঘাট শহরে চল রয়েছে।
নদীর উজান ঠেলে বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে আত্রেয়ীতে এই রুপোলি মাছের আগমনের এখন দিনগোনার পালা। পুজোর আগে আত্রেয়ীর এই সুস্বাদু রাইখর মাছের কথা মনে হতেই ভোজনরসিক শহরবাসীর মন কেমন হয়ে যায়। কবির ছড়ায়, গল্পকারের গল্পে সেই কবে থেকে রাইখরের সুখ্যাতি তো রকমারি রান্নার স্বাদে। এ বারে জেলা মৎস্য দফতরের উদ্যোগে বালুরঘাটে খুব সম্প্রতি নদী উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে রাইখর মাছের উৎসব নিয়েও উৎসাহ দেখিয়ে শহরের পরিবেশপ্রেমী সংস্থাগুলি মৎস্য বিভাগের কর্তাদের কাছে দাবি জানিয়েছে।
আকারে ছোট। তা হলেও ভাজা, কালোজিরে কাচা লঙ্কার পাতলা ঝোল সকলের প্রিয়। পেটের সমস্যায় ভোগেন, তারা তো রাইখরের এই রেসিপিতে মজে যান। আবার সর্ষে মাখা বা পেঁয়াজ রসুন দিয়ে কষা রান্নার স্বাদে রাইখরের কদরই আলাদা। পোস্তর সঙ্গে অল্প পরিমাণে কালো সর্ষেবাটা ও কাঁচা লঙ্কা দিয়ে রাইখর গরম ভাতে অনবদ্য হয়ে ওঠে। বিশেষত বড় মাপের রাইখরের এক পিঠে ঝাল ও অপর পিঠে টক গা-মাখা রেসিপির সঙ্গে সরু চালের গরম ভাত ভোজন রসিকদের চিন্তাতেই জিভে জল চলে আসে।
রাইখরের প্রসঙ্গ উঠতেই প্রখ্যাত নাট্যকার হরিমাধব মুখোপাধ্যায়ের চোখেমুখে উচ্ছ্বাস তুলে রাইখর নিয়ে পুরনো দিনের আনন্দ উচ্ছ্বল দিনের স্মৃতিকথায় হারিয়ে গেলেন। হরিমাধববাবু বলেন, বালুরঘাটে কোনও অতিথিকে ভালো কিছু খাওয়াতে হলে রাইখর ছাড়া আর কিছু মনে আসে না। হরিমাধববাবু থলে হাতে নিয়মিত বাজার করেন। শহরের বড় মাছের বাজারে গেলেই প্রথমে রাইখর খোঁজেন। তার কথায়, রাইখরের এক পিঠে ঝাল, অন্য পিঠে টকের অসাধারণ স্বাদের রেসিপির তুলনা হয় না। দুটো বড় সাইজের রাইখর মাছের ভাজা পেলেও খুশি হরিমাধববাবু। গরম ভাতে গাওয়া ঘি, কাঁচা লঙ্কা আর এক চিমটে নুন সহযোগে সর্ষের তেলে ভাজা বড় আকারের কয়েকটি রাইখর মাছ দিয়ে এক থালা ভাত এখনও খেয়ে নিতে পারেন প্রাক্তন শিক্ষক তথা খেলোয়াড় হরিপদ সাহা। তাঁর কথায়, রাইখরের সর্ষেভাপা কিংবা গামাখা কালিয়া রান্নার স্বাদ বাড়িতেই মেলে। শহরের হোটেল রোস্তোরাঁগুলিতে রাইখর নিয়ে রকমফের রান্নার ঝুঁকি কাউকে নিতে দেখা যায় না।
রান্নার হোটেল মালিকদের বক্তব্য, শহরে বাইরের লোক কোথায়? আদালতের কাজে গ্রামগঞ্জ থেকে যারা আসেন, তারা সস্তার খাবারই বেশি পছন্দ করেন। কেননা প্রমাণ সাইজের রাইখরের প্রতিকেজির দাম প্রায় ৫০০ টাকা। একটি রাইখরের এক পিঠে ঝাল, অন্য পিঠে টকের রেসিপি তৈরি করা হলে একটির দাম অন্তত ৭০ টাকা পড়ে যাবে। তাই ঝুঁকি নেন না শহরের রেস্তরাঁ কিংবা খাবারের হোটেলগুলি।
অবশ্য তাতে কুছ পরোয়া নেই। এমন মাছের স্বাদ গৃহিণীর হাতে পেতে শহরের আর এক কবি তথা পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও বেশি পছন্দ করেন। পুরো নস্টালজিক হয়ে দীপঙ্করবাবু বলেন, আত্রেয়ীর রাইখরের স্বাদ কোথাও খুঁজে পাইনি। পুরনো সেই সাত আট ইঞ্চি আকারের চকচকে রুপোলি রাইখরের ঝোল ভাজা খাওয়া শুরু হয় পুজোর আগে থেকে। বর্ষা শেষে ওই সময় থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে রাইখর মাছ বালুরঘাটের কংগ্রেসঘাট ও কল্যাণী খেয়াঘাটে ধরা পরতো। কত সস্তা দাম ছিল। বাইরের জেলার কত বন্ধুবান্ধব থেকে আত্মীয় এই মাছ খেয়ে কত সুখ্যাতি করেছেন, কি বলব! দীপঙ্করবাবুর মতো শহরের ছোট পত্রিকা সম্পাদক পীযূষকান্তি দেব, কবি মৃণাল চক্রবর্তী রাইখর পেলেই বাজার থেকে তুলে নেন। ঝাল টকের বদলে কাচালঙ্কা চিরে কালোজিরের পাতলা ঝোল তাদের পছন্দ বেশি। পীযূষবাবু বলেন, এখন পুকুরেও রাইখরের চাষ হয়ে বাজারে উঠছে। কিন্তু আত্রেয়ীর রাইখর তুলনাহীন। ছেলেমেয়ে কলকাতা ও হায়দরাবাদ থেকে বাড়িতে এলেই শুরু হয়ে যায় রাইখরের নানান পদ।
গত কয়েক বছরে আত্রেয়ী নদীর এই নিজস্ব রুপোলি ফসলের আগমন কমে আসছে। আত্রেয়ী পাড়ের মৎস্যজীবী ভীম হালদার, যোগেন হালদারেরা বলেন, সাত-আট ইঞ্চির সেই প্রমাণ আকারের রাইখরের ঝাঁক অমিল। নদীময় জাল টেনেও মেলে না। এ বারে এক টানা ভারী বৃষ্টির দেখা নেই। ভরা আত্রেয়ীতে জোয়ারের টানে বাংলাদেশের দিক থেকে রাইখর আসে। এখন ও পার বাংলাদেশ থেকে আত্রেয়ীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে জল নিয়ন্ত্রণের জেরে নদীতে সেই ভরা রূপ নেই। তবে বড় আকারের রাইখরের চাষ তারা নদীতে কাঠা দিয়ে করেন। সেই রুপোলি মধ্যে রেখা থাকা টাটকা রাইখর মাছ বাজার আলো করেই নিমেষে ভোজন রসিকের থলে থেকে একেবারে বাড়ির হেঁসেলে চলে যায়। রাধুনি বাটা দিয়ে রাইখরের ঝোলের ঘ্রাণ মম করে পাড়া জুড়ে।
আত্রেয়ী, পূর্বদিকে বাংলাদেশ থেকে এ জেলার কুমারগঞ্জ ব্লক হয়ে বালুরঘাট শহরের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ দিকে ফের বাংলাদেশে গিয়ে মিলিত হয়েছে চলনবিলে। বিশাল ওই বিল থেকে চুনো রাইখরের ঝাঁক দক্ষিণ দিক থেকে বালুরঘাটের দিকে যাত্রা শুরু হয়। সেপ্টেম্বরে শুরু থেকে অক্টোবর-ডিসেম্বরে গিয়ে চুনোরা বড় হয়ে বালুরঘাটে আত্রেয়ী দাপাতে থাকে। আর সে সময় থেকেই জেলের জালে উঠতে থাকে প্রমাণ আকারের রাইখর। তবে সেই দিন আর নেই। বাংলাদেশের দিক থেকে শুরু করে এ পারেও জায়গায় জায়গায় নদীতে আড়াআড়ি জাল ফেলে মাছ ধরায় রাইখরেরা উজানে যেতে বাধা পাচ্ছে। আগেই ধরা পড়ছে চুনো পোনারা। ফাঁকফোকর দিয়ে যেটুকু আসতে পারছে তাদের সারারাত জেগে বালুরঘাটে শুরু হয়েছে নদী বরাবর জালটানা। চ্যালা, চুনোপুঁটিদের সঙ্গে উঠছে রাইখরের ছানাপোনাও। অধিকাংশই আকারে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি। একটু বড় মাপের রাইখর চারশো থেকে পাঁচশো টাকা। সকালে বালুরঘাটের মাছবাজারে আসতেই নিমেষে উধাও। অপেক্ষাকৃত ছোট রাইখর তিনশো টাকায় মিলে যেতে পারে। তবে আশার কথা, নদীতে কাঠা দিয়ে (জল ঘিরে রেখে) মৎস্যজীবীরা রাইখরকে বড় করে তোলেন। প্রাচ্যভারতীর গৃহবধূ চম্পা দাস বলেন, একটু বড় সাইজ পেলে ভালো। তাতে ঝাল টকের রেসিপি ভালো হয়। তবে ছোট পেলেও সমস্যা নেই। পেঁয়াজ রসুন, আদা ও জিরে বাটা দিয়ে কষা রাইখর পেলে মাংসের কথা ভুলে থাকা যায়। এক রাইখর মাছের সাত রকম রান্নার রেসিপি নিয়ে প্রস্তুতির দিন আর বেশি দূরে নেই। সামনেই পুজোর মরসুম। বালুরঘাটের খিদিরপুর জেলেপাড়ায় রাইখরের জোগান দিতে মৎস্যজীবীদের মধ্যে ব্যস্ততা বাড়ছে। গরম সর্ষের তেলের কড়াইয়ে নুন হলুদ মাখিয়ে রাইখরের ভাজা থেকে ভোজনরসিকের খাওয়া শুরু। এর পর ওই ভাজা রাইখর নানা মশলা ও উপকরণের সঙ্গে গৃহকর্ত্রীর হাতে নানা পদ্ধতিতে তৈরি হয়ে আসে জিভে জল আনা ওই সমস্ত রেসিপি। এমন মানুষ কমই আছেন, যাঁরা বালুরঘাটে এক বার এসে রাইখরের স্বাদ না নিয়ে ফিরে গিয়েছেন। দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় থেকে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আত্রেয়ীর রাইখর মাছের ঝাল ও ঝোলের স্বাদ নিয়ে গিয়েছেন।
টক-ঝাল: তেঁতুল গোলার সঙ্গে সামান্য হলুদ মিশিয়ে একটি পাত্রে এবং প্রয়োজন মতো কাচা কিংবা শুকনো লঙ্কা বাটা সঙ্গে পেঁয়াজ রসুন আদা বাটা দিয়ে কষে নিয়ে আলাদা পাত্রে তৈরি করে নিতে হবে। এবার কড়াইয়ে রাইখরকে হালকা করে ভেজে তুলে নিয়ে একপিঠে তেঁতুল গোলার প্রলেপ লাগিয়ে ফের সে দিকটা ভেজে তুলে নিতে হবে। এর পর অন্য পিঠে লঙ্কা পেঁয়াজের ওই প্রলেপ মাখিয়ে ভেজে কড়াই থেকে তুলে নিতে হবে। যাতে মাছের দুই পিঠে ওই দুই প্রলেপের পুরু আস্তরণ থাকে। সব মাছ এইভাবে ভাজা হয়ে গেলে জিরে বাটা আদা কড়াইয়ে দিয়ে একটু কষিয়ে জল দিয়ে প্রলেপ দেওয়া রাইখর মাছগুলিকে ছেড়ে দিয়ে হবে। অল্প আঁচে হালকা নেড়ে ওভেন বন্ধ করে কড়াইয়ে ঢাকা দিলে তৈরি রাইখরের এক পিঠে ঝাল, অন্য পিঠে টকের রেসিপি।