জলপাইগুড়ি শহরের ফুটপাতের বাজারে বসেছে সুবীর দেবনাথ ও শচীন রায়। ছবি: সন্দীপ পাল
ফুরিয়ে আসা জ্যৈষ্ঠের ভোরে কুয়াশার গুঁড়োর মতো বৃষ্টি ঝরছে। বেগুন, টোম্যাটো, পটলের গায়ে জলের ছিটে দিচ্ছে লোকেশ। ভারতীয় উপমহাদেশে আলেকজান্ডার এসে পৌঁছেছেন— এই পর্যন্ত পড়ে গত বছর সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস বই বন্ধ করে দিয়েছিল সে। এক বছর কেটে গেল, বই আর খোলা হয়নি তার।
ভ্যান থেকে শোলাকচু নামিয়ে একটি প্লাস্টিকের পাত্রের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখার চেষ্টা করছে সৌরভ। বছরখানেক ধরে দোকানদারি করে নবম শ্রেণির পড়ুয়া সৌরভ বুঝে গিয়েছে, কেনার আগে অনেকেই শোলাকচু হাতে নিয়ে পরখ করে নেন। দাঁড় করানো থাকলে কচু বেছে নিতে সুবিধে হবে ক্রেতাদের। এখন বীজগণিতের একটি সূত্রও আর না-দেখে বলতে পারে না সৌরভ।
তাজা ঢেঁড়সগুলো বেছে সামনে সাজায় নবম শ্রেণির সুবীর। রোল নম্বর কত ছিল, ঠিক মনে করতে পারে না। গত বছর ওরা যে সময়টায় স্কুলে যেত, এখন সেই সময়ে চলেছে তাদের দোকানদারি।
জলপাইগুড়ি শহরের পোস্ট অফিস মোড়ে ফুটপাতে পরপর পাঁচটি আনাজের দোকান নিয়ে একখণ্ড বাজার। ওই বাজারে প্রথমে দুই ভাই সৌরভ-শচীন বসত দোকান দিয়ে। জলপাইগুড়ির আনন্দ মডেল হাইস্কুলের ছাত্র তারা। সৌরভ নবম এবং শচীন ষষ্ঠ শ্রেণির। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ওরাই দোকান সামলাত, বিকেলের পরে মা-বাবাও আসতেন। কিছু দিন পরে সৌরভ-শচীনের পাশের দোকানে খুলল সুবীর। সে জলপাইগুড়ি হাইস্কুলের ছাত্র। বলল, “লকডাউনের পরে তো পড়া বন্ধ হয়ে গেল। মোবাইলে আমি এক দিনও ক্লাস করতে পারিনি। বাবা এখানে আনাজ বিক্রি করত, আমাকেও দোকানে বসতে বলল। এসে দেখলাম, পাশের দোকানে আমার মতোই একটা ছেলে। বন্ধুত্ব হয়ে গেল।”
শম্পাও আসে দোকানে। পান্ডাপাড়া কালীবাড়ির পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। তবে অন্যদের মতো সকালে আসে না সে। ছোট বলে দুপুরে আসে।
ওদের বাবা-মায়েদের কেউ ভ্যান চালাতেন, কেউ সহায়িকার কাজ করতেন। গত বছর লকডাউনে অনেকেরই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তখনই শহরের এক ফুটপাত খুঁজে আনাজের বাজার বসিয়েছিলেন ওঁরা। পরে যুক্ত হল বাড়ির ছোটরা। সব ক’জনের দাবি, স্কুল বন্ধ হওয়ার পরে তাদের কেউ এক দিনও অনলাইন ক্লাস করেনি। তার পরে লকডাউন উঠে গিয়েছে। কিন্তু স্কুল খোলেনি। বাবা-মায়েরা কাজে ফিরেছেন। দোকান সামলানোর ভার তাই খুদেদের উপরই। সৌরভের মা বাসবী বলেন, “ছেলেগুলি সারাদিন বাড়িতে কী করবে! স্কুল খুললে আবার পড়তে পাঠাব।” স্কুল বন্ধ মন খারাপ হয় না? সৌরভ বলে, “হয় তো। বন্ধুদের দেখি না কত দিন।” পাশ থেকে সুবীর বলে, “একজন স্যর তো আমার থেকে সে দিন ঝিঙে নিলেন। আমি ভাল দেখে বেছে দিলাম।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy