দেহ ৯৮% দগ্ধ অবস্থায় মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কোনও ব্যক্তির বয়ান নিয়ে সন্দেহ করা ঠিক নয়। দোষী সাব্যস্ত করার জন্য সেই বয়ানকে হাতিয়ার করা যেতেই পারে। এক ব্যক্তিকে গায়ে লাগিয়ে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় রায় ঘোষণা করে জানাল কলকাতা হাই কোর্ট। বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজ এবং বিচারপতি অপূর্ব সিংহ রায়ের ডিভিশন বেঞ্চ নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখেছে। দুই বিচারপতির বেঞ্চ জানায়, নিম্ন আদালতের নির্দেশ মতো অভিযুক্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল।
বেলেঘাটার ঠাকুরবাগান এলাকায় ফুটপাতে উপহার সামগ্রীর দোকান চালাতেন সঞ্জয় হালদার। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ দোকান বন্ধ করে তিনি বাড়ি ফিরছিলেন। তিনি ভাড়া থাকতেন। পুলিশি তদন্তে উঠে আসে, সঞ্জয় বাড়ির সামনে এসে দেখেন অরিজিৎ চট্টোপাধ্যায়-সহ প্রতিবেশী কয়েক জন যুবক মদ্যপান করছেন। অরিজিৎ তাঁর বাড়ির মালিক। ওই ঘটনায় প্রতিবাদ করেন সঞ্জয়। তাঁদের সঙ্গে তিনি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। এর পরেই অরিজিতের কথায় মধু এবং ফুচকা নামে দুই যুবক সঞ্জয়ের শরীরে, মাথায় কেরোসিন তেল ঢেলে দেন। সঞ্জয়ের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন ফুচকা। নিজেকে বাঁচাতে পুকুরে ঝাঁপ দেন সঞ্জয়। পরে পুলিশ গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে ও হাসপাতালে ভর্তি করায়।
হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরে সঞ্জয় দু’বার বয়ান দেন। প্রথম বার চিকিৎসককে তিনি জানান, কয়েক জন ব্যক্তি কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন। পরে সঞ্জয় পুলিশকে পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিন জনের নাম বলেন। পায়ের কিছু অংশ ছাড়া তাঁর দেহের ৯৮ শতাংশ পুড়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তি করানোর ১৭ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হয় সঞ্জয়ের। ওই ঘটনায় বেলেঘাটা থানার পুলিশ তদন্ত শুরু করে। পুড়িয়ে মারার কারণ হিসাবে পুলিশ জানতে পারে, বাড়িওয়ালা অরিজিৎ বহু দিন ধরে সঞ্জয়কে বাড়ি খালি করতে বলছিলেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি। এর জেরেই পরিকল্পিত ভাবে তাঁকে পুড়িয়ে মারা হয়। ওই খুনের ঘটনায় শিয়ালদহ আদালত অভিযুক্তকে অরিজিৎকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করে। নিম্ন আদালতের ওই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে অরিজিৎ হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন। পুলিশের তদন্তে একাধিক ত্রুটি রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
আরও পড়ুন:
অরিজিতের পক্ষে আইনজীবীর যুক্তি, মৃত ব্যক্তি মদ্যপানে অভ্যস্ত ছিলেন। অতীতে তিনি একাধিক বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ঘটনার সময় তিনি শারীরিক এবং মানসিক ভাবে অসুস্থ ছিলেন। কোনও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া সঞ্জয় দু’রকম বয়ান দিয়েছিলেন। চিকিৎসককে দেওয়া প্রথম বয়ানে কারও নাম ছিল না। হাই কোর্টে পুলিশের পক্ষ থেকে পাল্টা জানানো হয়, এফআইআর এবং মৃত্যুকালীন বয়ান দুটোতেই স্পষ্ট ভাবে ঘটনা ও আসামির নাম রয়েছে। চিকিৎসকের রিপোর্ট বলছে, বয়ান দেওয়ার সময় মৃত সচেতন ছিলেন। অরিজিৎ ছাড়া বাকি অভিযুক্তরা পলাতক। ফলে ওই ঘটনা পরিকল্পিত ছিল এটা বলাই যায়।
হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ, প্রথম ও দ্বিতীয় মৃত্যুকালীন বয়ানের মিল রয়েছে। দুটোতেই বলা হয়েছে অন্যেরা কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছেন। দ্বিতীয় বয়ানে শুধু অভিযুক্তদের নাম রয়েছে। চিকিৎসক বলেছেন, বয়ান দেওয়ার সময় সঞ্জয় সচেতন ছিলেন এবং নিজের পরিচয়, ঠিকানা, দোকানের অবস্থান ইত্যাদি ঠিকঠাক বলেছেন। যা মানসিক ভাবে সতর্ক থাকার প্রমাণ। তা ছাড়া মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কোনও ব্যক্তির বয়ান নিয়ে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। সব মিলিয়ে আদালত মনে করছে অপরাধ প্রমাণিত। এর পরেই বিচারপতি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চ দোষীর আবেদন খারিজ করে দেয়।