E-Paper

উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র নামেই, চিকিৎসা হচ্ছে কুঁড়েঘরে

দক্ষিণ কোরাকাটি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবশ্য নিজস্ব দু’টি ছোট ঘর, একফালি বারান্দা আছে। কয়েক মাস আগে এটি সুস্বাস্থ্যকেন্দ্রে উন্নীত হয়েছে। তবে নামেই। পরিকাঠামোর উন্নতি হয়নি।

নবেন্দু ঘোষ 

শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৪ ০৪:৫৮
sandeshkhali

জ্যোতিষপুর উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র (ডান দিকে)। পাশে গোয়ালঘর। — নিজস্ব চিত্র।

ছোট একটি কুঁড়ে। চাল অ্যাসবেসটসের। বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। নেই শৌচাগার, জলের ব্যবস্থা বা দু’জন বসার মতো জায়গাও। তা হলে আছে কী? মাটির জরাজীর্ণ দেওয়াল আছে। বৃষ্টি হলে জল পড়ার সমস্যা আছে।

কুঁড়ের একটি পোশাকি নাম জ্যোতিষপুর উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ঠিকানা— সন্দেশখালি ২ ব্লকের দুর্গামণ্ডপ পঞ্চায়েত। এটি বার্ষিক ১০ হাজার টাকা ভাড়ায় চলে। প্রসূতিরা এসে ভিড় দেখলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। গরমে পুড়তে হয়। বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। পাশের বাড়ির গোয়ালের কটূ গন্ধ নাকে এসে লাগে। প্রসূতিদের কোনও শয্যায় শুইয়ে পরীক্ষা করার কথা ভাবতেও পারেন না স্বাস্থ্যকর্মীরা।

রাজ্যে পালাবদলের পরে নানা প্রান্তে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হয়েছে। কিন্তু দু’মাস ধরে সংবাদ শিরোনামে থাকা উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি ২ ব্লকের স্বাস্থ্য পরিষেবা এখনও তিমিরেই রয়ে গিয়েছে। এখনও রোগ একটু জটিল হলেই গ্রামবাসীদের যেতে হয় প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে বসিরহাট মহকুমা হাসপাতালে, নয়তো ক্যানিং মহকুমা হাসপাতালে। গত ১৩ বছরে একটিও নতুন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু হয়নি। অথচ, জনসংখ্যা বেড়েছে। নাবালিকা বিয়েতে লাগাম পরেনি। ফলে নাবালিকা মায়ের সংখ্যা এবং তার সঙ্গে জুড়ে থাকা ঝক্কি— কোনওটাই কমেনি।

শুধু কি জ্যোতিষপুর? এমন আরও তিনটি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র ভাড়াঘরে চলছে সেই বাম আমল থেকে। গ্রামবাসীদের দাবি, এই ব্লকে বাম জমানায় ৩৫টি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি হয়েছিল।

বাকি কেন্দ্রগুলির নিজস্ব ভবন থাকলেও অনেকে ক্ষেত্রেই তার অবস্থা এবং পরিষেবা নিয়ে অভিযোগ বিস্তর। কোড়াকাটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা মেলে না। তৃণমূল জমানায় সাতটি নতুন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা হয়। দু’টি কেন্দ্র তৈরির কাজ চলছে। বাকি পাঁচটির কাজ শুরুই হয়নি।

বেড়মজুর ১ পঞ্চায়েতের পোলপাড়া উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চলে রফিক ঢালি নামে এক গ্রামবাসীর মাটির বাড়ির বারান্দার এক কোণে। এখানেও বিদ্যুৎ সংযোগ, শৌচাগার, জলের ব্যবস্থা— কিছুই নেই। একই হাল কোরাকাটি পঞ্চায়েতের তুষখালি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রেরও।

দক্ষিণ কোরাকাটি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবশ্য নিজস্ব দু’টি ছোট ঘর, একফালি বারান্দা আছে। কয়েক মাস আগে এটি সুস্বাস্থ্যকেন্দ্রে উন্নীত হয়েছে। তবে নামেই। পরিকাঠামোর উন্নতি হয়নি।

স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, বৃষ্টি হলে ঘরে ছাদ থেকে জল পড়ে জমে থাকে। এখানেও পানীয় জলের ব্যবস্থা, শৌচাগার নেই। ঘর এত ছোট যে, দু’জন স্বাস্থ্যকর্মী চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসতে পারেন না। এক জনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এখানে টেলি-মেডিসিন পরিষেবা চালু করার পরিকল্পনা করে কয়েক মাস আগে শুধু ভবনের সামনের দিকে একটি দেওয়ালে রং করে ‘সুস্বাস্থ্যকেন্দ্র’ লিখে দেওয়া হয়। সেই দেওয়ালের আবার প্লাস্টার খসে পড়েছে। ভিতরে সংস্কার হয়নি। এক মাস আগে বারান্দার চাঙড় খসে পড়েছিল। সেখানে তখন মা ও শিশুরা ছিলেন। কোনওক্রমে রক্ষা পান সবাই।

কোরাকাটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসূতি বিভাগ চলছে এক বছর ধরে। মাসে ২০-২৫ জন প্রসূতি ভর্তি হন। কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা নেই। কোনও রোগী বা প্রসূতিকে ‘রেফার’ করা হলে বড় তুষখালি ফেরিঘাট পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার তাঁদের আসতে হয় ভ্যান বা টোটোয়। ফলে, প্রয়োজনেও রোগীর অক্সিজেন মেলে না।

গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি, কয়েক মাস আগে টোটোতে নিয়ে যাওয়ার সময়ে অক্সিজেনের অভাবে একটি বাচ্চা মারা গিয়েছে। প্রসূতিদের পথে প্রসবও হয়ে যায়। সুখদুয়ানি গ্রামের তাপসী মণ্ডল সম্প্রতি মা হয়েছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘‘কোরাকাটি হাসপাতালে যখন প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে ইঞ্জিনভ্যানে করে যাচ্ছিলাম, ঝাঁকুনিতে মনে হচ্ছিল, পথেই প্রাণ বেরিয়ে যাবে। বাচ্চাকে নিয়েও সে ভাবেই ফিরি। অ্যাম্বুল্যান্স কবে চালু হবে, কে জানে!’’ তিনিই জানান, হাসপাতালে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। বাড়ি থেকেই খাবার আনতে হয়।

সন্দেশখালি গ্রামীণ হাসপাতালে রোগীর একটু বড় সমস্যা হলেই ‘রেফার’ করা হয় বলে গ্রামবাসীদের অভিযোগ। ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক কৌশিক মণ্ডল এ সব কথা মানেননি। বলেন, ‘‘অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা ও হাসপাতালে রোগীদের খাবার দেওয়ার বিষয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। গ্রামীণ হাসপাতালে পরিষেবার কোনও ত্রুটি নেই। জটিল রোগ ছাড়া ‘রেফার’ করা হয় না।’’

বিডিও অরুণকুমার সামন্ত জানান, ব্লকের ২৩টি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র সংস্কার করা হলে আর সমস্যা থাকবে না। ভাড়াবাড়িতে যেগুলি চলছে, সেখানে বিনামূল্যে জমি পেলে ভবন করা হবে।

যথারীতি এলাকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক তরজাও বহাল। প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক নিরাপদ সর্দার বলেন, ‘‘তৃণমূল সরকার কিছুই করেনি সন্দেশখালির মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য। যা পরিকাঠামো তৈরি, সব বাম আমলে।’’ পক্ষান্তরে, তৃণমূল বিধায়ক সুকুমার মাহাতোর দাবি, ‘‘বাম জমানায় কী হয়েছে জানি না। আমাদের জমানায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। যা সমস্যা আছে, সমাধান করা হবে।’’

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

sandeshkhali Women Health sector

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy