Advertisement
E-Paper

‘ছোট ছেলের চাকরিটা হয়ে গেলে পুরী যেতে চাই’

কিন্তু আমি পারতাম। বড় ছেলে বিকাশকে ন’মাস বয়সে কোলে করেই পূর্ববঙ্গ থেকে পা রেখেছিলাম এই দেশে। বেলগাছিয়ায় ননদের বাড়িতে প্রথম উঠেছিলাম। বিকাশ খুব শান্ত ছিল, যেমন করে ভাত মেখে দিতাম, সেটাই খেয়ে নিত। এখন কেমন যেন সব বদলে গিয়েছে।

শান্তিপ্রভা দেব

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৮ ০১:৩১
শান্তিপ্রভা দেব। ফাইল ছবি

শান্তিপ্রভা দেব। ফাইল ছবি

ওরা নিয়ে গেল না!

কত করে বললাম, তোরা যাচ্ছিস তো। আমাকেও পুরী নিয়ে চল। বিকাশরা বলল, ‘তুমি পারবে না।’

কিন্তু আমি পারতাম। বড় ছেলে বিকাশকে ন’মাস বয়সে কোলে করেই পূর্ববঙ্গ থেকে পা রেখেছিলাম এই দেশে। বেলগাছিয়ায় ননদের বাড়িতে প্রথম উঠেছিলাম। বিকাশ খুব শান্ত ছিল, যেমন করে ভাত মেখে দিতাম, সেটাই খেয়ে নিত। এখন কেমন যেন সব বদলে গিয়েছে।

মাথার দু’পাশে বিনুনি করে লাল ফিতে দিয়ে চুল বেঁধে দিত কাকিমা। বাড়ির ছোট মেয়ে ছিলাম বলে সক্কলে ভালবাসত। বাড়ি তৈরির ঠিকাদার বাবা দুর্গাচরণ করচৌধুরী প্রতিদিন সকালে হাত ধরে পৌঁছে দিতেন আমাদের সালু চো গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে। স্কুলে গিয়ে পড়তাম অ-এ ‘অজগর’, র–এ ‘রামধনু’। আমার দাদা-দিদিরা খুব আদর করত, মেলা থেকে চুড়ি, গুড়কাঠি, ছোলাভাজা কিনে দিত। সারা দিন বাড়িতে কত মজা করতাম। কিন্তু লাল গাড়িগুলো গ্রামের মেঠো রাস্তা দিয়ে গেলেই ভয় হত। কালো টুপি পরা ফর্সা সাহেবরা বলত, ‘সাবধান, ছেলেদের সামলে রাখ।’ সালটা বোধহয় ’৪২ কি ’৪৩।

ভারত স্বাধীন হওয়ার কথা এত মনে নেই। মা বেশি বাড়ির বাইরে বেরোতে দিত না। মাঝেমধ্যে মায়ের হাত ধরে চট্টগ্রামে গুরুদেবের আশ্রমে যেতাম। আর ১৫ বছরে পা দিতেই কাশেরদা গ্রামের কবিরাজ বিপিনচন্দ্র দেবের বড় ছেলে সুকুমারচন্দ্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। প্রথমে খুব ভয় করত। কী জানি, শ্বশুরবাড়িতে সবাই হয়তো খুব বকুনি দেবেন! কিন্তু আমার শ্বশুরমশাই আমাকে খুব ভালবাসতেন। আমি বাঁ হাত দিয়ে খুন্তিটা এক বার কড়াইতে ঘুরিয়ে দিলেই উনি বলতেন ‘অমৃত হয়েছে।’ আমিও নিজের পছন্দ মতো এক দিন ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক, নোনা ইলিশ ভাজা, সর্ষে ইলিশ রান্না করতাম। সব চেটেপুটে খেতেন আমার শ্বশুর থেকে দেওরেরা। ছোট দেওর ল্যাজা আর সেজ দেওর মাছের মাথা খেতে খুব ভালবাসত। মাঝেমধ্যেই শ্বশুরমশাই ওঁদের বলতেন, ‘‘তোরা সব খ্যাইয়া লইছিস, বৌমা খাব কী?’’ মুখ পর্যন্ত ঘোমটা ঢাকা দিয়ে আমি হাসতাম।

কত সালে যেন একটা আবার যুদ্ধ শুরু হল। কি যেন বলে সক্কলে, মুক্তিযুদ্ধ। সেই যুদ্ধ লাগার আগে, না পরে ঠিক মনে নেই। আমার বর গোঁ ধরলেন, কবিরাজি ছেড়ে তিনি চাকরি করবেন। আমিও কী আর করব! নিজের সোনার কানের দুল বন্ধক দিয়ে টাকা জোগাড় করে এ দেশে আসার টিকিট কাটলাম। বিদায় নিলাম কুমিল্লা থেকে। আর কোনও দিন ও দিকে যাওয়াই হয়নি।

ভারতে এসে সেটলমেন্ট অফিসে চাকরি পেলেন বিকাশের বাবা। এক দিন খবর এল, শ্বশুরমশাই মারা গিয়েছেন। খুব কাঁদলাম, কিন্তু যেতে পারলাম না। কে নিয়ে যাবে? তত দিনে ভুলু হয়েছে। দু’টিকে নিয়েই আমার দিন কেটে যেত। ছোট থেকেই খুব দুষ্টু ছিল ভুলু। হামাগুড়ি দিয়ে খালি দরজার বাইরে চলে যেত। তখন ওদের বাবার লালগোলায় পোস্টিং। ভুলু একটু বড় হয়েছে, বিকাশ মাঝেমধ্যেই ওকে নিয়ে বাবার অফিসে চলে যেত। আমিও বারণ করতাম না। দু’জনকে হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেতাম। বদমায়েশি করলে বকুনি দিতাম, তবে লাঠিপেটা করিনি।

কয়েক দিন আগে ভুলু আমাকে লাঠিপেটা করছে বলে পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে গেল। আমার ছেলে মারে না। ও তো লাঠি নিয়ে আমাকে ভয় দেখায়। ওর সঙ্গেই তো থাকি, সেই কত বছর আগে থেকে। সম্বন্ধ করে বিকাশের বিয়ে দিয়েছিলাম। বাবার চাকরিও পেল বিকাশ। ওদের বাবা চলে যাওয়ার পরে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ধারে বাড়ি ভাঙতেই সরকার টাকা দিল। এক ভাগ নিয়ে বিকাশ দত্তপুকুরে বাড়ি করল। খুব একটা আর আসে না।

৮২ বছর বয়স হল। ভুল করে বাড়ি নোংরা করে ফেলি। তাই ভুলু মারের ভয় দেখায়। ওর একটা চাকরি হয়ে গেলেই আমাকে পুরী নিয়ে যাবে।

তাতেই আমার মুক্তি!

(দিন কয়েক আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিয়ো ভাইরাল হয়। সেখানেই দেখা যায়, শান্তিপ্রভাকে লাঠি উঁচিয়ে মারছেন তাঁর ছোট ছেলে ভুলু। পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছিল। পরে তিনি জামিন পান।)

Mother Torture Son
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy