মহিলা থানা বাদ দিলে শহরে থানার সংখ্যা ৭৯। কিন্তু সেই সব থানায় মহিলা ওসি-র (অফিসার ইনচার্জ) সংখ্যা? শূন্য।
বছর পনেরো আগে প্রথম এবং শেষ বার কোনও এলাকার থানায় মহিলা অফিসারকে ওসির দায়িত্ব দেওয়া হয় কলকাতা পুলিশে। তিনি সেই পদ থেকে সরে যাওয়ার পরে কেটে গিয়েছে পাঁচ বছরেরও বেশি। আর কোনও মহিলা ইনস্পেক্টরকেই কোনও থানার ওসির দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। বাহিনীর অন্দরের অভিযোগ, একসঙ্গে কাজে যোগ দেওয়ার, একই রকম প্রশিক্ষণ নেওয়ার এবং তার পরে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে কাজ করা সত্ত্বেও মহিলা অফিসারদের থানার ওসি করা হয় না। মহিলা ইনস্পেক্টরের উপরে বর্তায় শুধু মহিলা থানার দায়িত্বই। সম্প্রতি কলকাতা পুলিশের ২১টি পদে রদবদল হয়েছে। ব্যাপক রদবদল হয়েছে রাজ্য পুলিশেও। কিন্তু সেই তালিকাতেও কোনও মহিলা ইনস্পেক্টরকে ওসি পদে বসানো হয়নি। অনেকেরই প্রশ্ন, ‘প্রথাগত বিভেদ’ ভেঙে কবে কলকাতার কোনও থানা মহিলা ওসি পাবে?
কলকাতা পুলিশের বিভিন্ন ডিভিশনেও একই ব্যাপার দেখা যায় বলে অভিযোগ। সাধারণত, এক জন আইপিএস অফিসারই কলকাতা পুলিশের কোনও অঞ্চলের ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) হন। কিন্তু থানা স্তর থেকে পদোন্নতি পেয়ে উঠে আসা অফিসারও অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার (এসি) হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আইপিএস মহিলা অফিসার ডিসি হলেও কলকাতা পুলিশের দশটি ডিভিশনের কোথাওই পদোন্নতি পেয়ে উঠে আসা কোনও মহিলা অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার নেই। এ নিয়ে ক্ষোভ উগরে বাহিনীর এক মহিলা অফিসার বললেন, ‘‘আমাদের দক্ষতা বা কাজের যোগ্যতা নিয়ে নিশ্চয়ই সংশয় আছে। না হলে বছরের পর বছর এমনটা চলবে কেন?’’ আর এক মহিলা অফিসারের মন্তব্য, ‘‘রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মহিলা। প্রশাসনিক নানা পদেও মহিলা আইএএস, আইপিএস, ডব্লিউবিসিএস অফিসার রয়েছেন। কিন্তু পদোন্নতি পাওয়া মহিলা ইনস্পেক্টরকে শুধু হয় মহিলা থানার দায়িত্ব, নয়তো খুব বেশি হলে কোনও থানার অ্যাডিশনাল ওসি করা হচ্ছে। সব রকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও থানার ওসি করা হবে না কেন, উত্তর নেই।’’
২০১০ সালে কলকাতার থানার প্রথম মহিলা ওসি হন দেবশ্রী চট্টোপাধ্যায়। নর্থ পোর্ট এবং তারাতলার ওসির দায়িত্ব সামলান তিনি। সেই পদ থেকে তাঁকে রাজ্য পুলিশে সরিয়ে দেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই এক পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তাঁর। তার পর থেকে আর কোনও মহিলাই সাধারণ থানার দায়িত্ব পাননি। দেখা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে ন’টি মহিলা থানায় ন’জন মহিলা ওসি আছেন। কিন্তু কোনও মহিলা থানাতেই অ্যাডিশনাল ওসি নেই। অন্য সমস্ত থানার মধ্যে একমাত্র হেয়ার স্ট্রিট থানায় অ্যাডিশনাল ওসি পদে রয়েছেন শ্রাবন্তী ঘোষ নামে এক মহিলা। কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগে রয়েছেন চার জন মহিলা অফিসার। তাঁদের মধ্যে সুচিস্মিতা মিশ্র মহিলাদের বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ের ডিসি। মহুয়া বিশ্বাস মহিলা ও শিশু রক্ষা সেলের এসি পদে রয়েছেন। তন্দ্রিমা গুপ্ত এবং শুক্লা ঝা গোয়েন্দা বিভাগে রয়েছেন, কিন্তু এখনও এই দু’জনকে কোনও দফতরের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। লালবাজারের হেড কোয়ার্টার্স এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চে যথাক্রমে জ্যোৎস্না দাস এবং শুক্লা সিংহ রায় নামে দুই মহিলা অফিসার এসি পদে রয়েছেন। হেড কোয়ার্টার্সের মহিলা পুলিশের ডিসি পদে রয়েছেন মাধুরী সরকার। লালবাজারেই কর্তব্যরত এক মহিলা পুলিশ অফিসারের মন্তব্য, ‘‘যাঁরা ডিসি বা এসি পদে উন্নীত হচ্ছেন, তাঁদেরও বাহিনীর অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বা মহিলা সংক্রান্ত বিভাগেই শুধু রাখা হচ্ছে। এই মনোভাবের কারণেই কি স্বাধীনতার এত বছর পরেও মহিলা কমিশনার পায়নি কলকাতা পুলিশ?’’ তাঁর আরও দাবি, রাজ্য পুলিশে কিন্তু মহিলা অফিসার থানা সামলাচ্ছেন।
প্রাক্তন পুলিশকর্তা গৌতমমোহন চক্রবর্তী বললেন, ‘‘কেন এমনটা হয়েছে বলা মুশকিল। এক সঙ্গে কাজে যোগ দিয়ে পদোন্নতি হয়ে এক র্যাঙ্কে পৌঁছলে মহিলা, পুরুষ নির্বিশেষে পদও এক রকম ভাবে হওয়া উচিত।’’ প্রাক্তন পুলিশকর্তা সলিল ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘নিয়োগের পর থেকে এক জন পুরুষের মতোই মহিলা অফিসার সমস্ত প্রশিক্ষণ নেন। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও ভেদাভেদ নেই। কিন্তু কাজের বণ্টনের সময়ে ভেদাভেদ করার এই উদাহরণগুলি আসলে মহিলা সহকর্মীদের উপরে বাহিনীর কর্তাদের পরোক্ষ অনাস্থা প্রকাশ করে।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘যদি ওসি করাই না হবে, তা হলে একই র্যাঙ্ক দেওয়া হল কেন?’’ বাহিনীর একাংশের দাবি, বর্তমানে থানার ওসি অনেক সময়েই এলাকার রাজনৈতিক সমীকরণ, নেতাদের মতামত ও পুলিশের উপরের তলার কর্তাদের মর্জির উপরে নির্ভর করে। এ ব্যাপারে কলকাতা পুলিশের কমিশনার মনোজ বর্মার বক্তব্য জানতে বার বার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। টেক্সট মেসেজও উত্তর দেননি। যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক অফিসারের সেই একই উত্তর, ‘‘মহিলা থানা তো আছেই। অনেকগুলি তো মহিলা থানা, সেগুলিকেও তো চালাতে হবে!’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)