বাড়িতে আসার পরে প্রথম দিকে মেয়েটি ঘুমোত খানিকটা জড়োসড়ো হয়ে। ঘুমের মধ্যেও সে নড়াচড়া করত না, সারা রাত থেকে যেত একই ভাবে। তার পরে কেটে গেল অনেকগুলো মাস। এক দিন দেখা গেল, সে আর আড়ষ্ট হয়ে ঘুমোচ্ছে না। পাশ ফিরছে, হাত-পা ছুড়ছে মাঝেমধ্যে। এই পরিবর্তন কেন? জানতে চাওয়ায় মেয়েটি উত্তর দিয়েছিল, ‘‘এখন তুমি আমার মা হয়ে গিয়েছ।’’
বছর সাতেকের দত্তক কন্যার মা হয়ে ওঠার যাত্রাপথে তিনি যে অনেকটা এগিয়ে যেতে পেরেছেন, সেই দিনই প্রথম উপলব্ধি করেন রাণু বন্দ্যোপাধ্যায়। বরাহনগরের রাণু ভাগ করে নিচ্ছিলেন বয়সে খানিকটা বড় কাউকে দত্তক নেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা। বলছিলেন, অনিশ্চয়তার কথা। যে অনিশ্চয়তা যতটা থাকে দত্তক মা-বাবার মধ্যে, তার চেয়ে বহু গুণ বেশি থাকে শিশুটির মধ্যে। জীবনের প্রথম কয়েকটি বছর যে ভাবে কাটিয়েছে সে, যে জায়গায় থাকতে অভ্যস্ত হয়েছে, যা যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তার— তাকে ঘরে নিয়ে এলেই কি সে সব মুছে ফেলা যায় সহজে? প্রশ্ন তুলে রাণু জানান, তিনি যতটা মানিয়ে নিয়েছেন, তার থেকেও বহু গুণ বেশি মানিয়ে নিয়েছে তাঁর মেয়ে। স্কুলে যাওয়ার অনিচ্ছাকে জয় করে ভালবেসে স্কুলে যাচ্ছে, যোগ দিচ্ছে খেলায়, শিখছে গান-আঁকা।
তাঁরা পারলেও বড় বয়সের শিশুদের দত্তক নেওয়ার পথটা এখনও ততটা সোজা নয়। কম বয়সের শিশু দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে সমাজের ছুৎমার্গ বহুলাংশে কাটলেও পাঁচ বছরের বেশি বয়সের শিশু দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে এখনও রয়েছে আড়ষ্টতা। দত্তক নেওয়ার প্রক্রিয়াও বাধামুক্ত নয়। এ নিয়েই একটি আলোচনার আয়োজন করেছিল শহরের দত্তক মা-বাবাদের এক সংগঠন ‘আত্মজা’। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে এই সংগঠন কাজ করে চলেছে দত্তক শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, দত্তক নিতে ইচ্ছুক দম্পতিদের দিশা দেখানো এবং সমাজে এ নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে। এ দিনের আলোচনায় বাবা-মায়েরা ছাড়াও ছিলেন সমাজকর্মী, শিশু অধিকার রক্ষা কর্মী ও সরকারি আধিকারিকেরা।
আলোচনায় উঠে এল, তিন থেকে দশ বা তারও বেশি বছরের শিশুদের দত্তক নেওয়া হলে বাবা-মার সঙ্গে যোগ তৈরিতে দেরি হয়, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে সময় লাগে বেশি। কারণ, তারা ইতিমধ্যেই এক বা একাধিক আশ্রয়কেন্দ্রে বেড়ে উঠেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপ্রীতিকর বহু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। প্রাক্তন অধ্যাপক, ‘আত্মজা’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নীলাঞ্জনা গুপ্ত জানান, বয়সে বড় শিশুদের ক্ষেত্রে নতুন পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠার পথে বার বার বাধা সৃষ্টি করে তাদের অতীত। যেমন, বছর তিনেকের একটি শিশু তার দত্তক বাবার কোলে গেলেও এড়িয়ে চলত দত্তক মা-কে। কারণ, জন্মদাত্রী মায়ের কিছু স্মৃতি তার ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে দত্তক মায়ের সঙ্গে আত্মিক যোগ তৈরি হয় তার। তাই তাড়াহুড়ো নয়, অভিভাবকের তরফে দরকার ধৈর্য, বিশেষ মানসিক প্রস্ততি। সমাজকর্মী সৌমেতা মেধোরার অভিজ্ঞতা বলছে, এই বয়সের শিশুরা আন্তরিক ভাবেই চায় তাদের কেউ দত্তক নিক। কিন্তু ভরসার পথে অন্তরায় হয় বাস্তব অভিজ্ঞতা। তাই বাবা-মায়েদের অনেক সংবেদনশীল হতে হবে। বুঝতে হবে, দত্তক নেওয়া মানে শুধু একটি শিশুকে ঘরে আনা নয়, তার অতীত, তার ভয়, তার স্বপ্নেরও দায়িত্ব নেওয়া।
তাই সভা থেকে আহ্বান ওঠে, বড় শিশুদের দত্তক নেওয়া নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। কারণ, এই প্রক্রিয়ায় শুধু একটি শিশু ঘর পায় না, একটি পরিবারেরও সন্তানলাভ হয়। নিজেদের বয়স বেড়ে যাওয়ায় সরকারি নিয়মের কারণে বাধ্য হয়ে নয়, আন্তরিক ভাবে বাবা-মায়েরা বেশি বয়সের শিশুদের আপন করে নিন, এ দিন ডাক আসে মঞ্চ থেকে।আত্মজার পক্ষ থেকে অঙ্গীকার করা হয়, বড় শিশুদের দত্তক সংক্রান্ত সহায়তা দেবে তারা। কারণ, একটি নিরাপদ, স্থায়ী ঘর প্রতিটি শিশুর অধিকার।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)