অতীতে দু’বার উপমা হিসাবে আদালতে উত্থাপিত হয়েছিল ধর্মতলায় তৃণমূলের ২১ জুলাইয়ের বার্ষিক সভার প্রসঙ্গ। গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে দু’বারই আদালত বিজেপি-কে সভা করার অনুমতি দিয়েছিল। প্রথমটি ২০১৬ সালে, দ্বিতীয়টি গত লোকসভা ভোটের আগের বছর ২০২৩ সালে। কিন্তু এই প্রথম ‘রাস্তা আটকে’ ২১ জুলাইয়ের সভা ঘিরে কড়া পর্যবেক্ষণ রাখল কলকাতা হাই কোর্ট। অর্থাৎ, মামলার বিষয়বস্তু এক হলেও আদালতের নির্দেশ এবং পর্যবেক্ষণে মৌলিক বদল ঘটেছে।
বামপন্থী আইনজীবী সংগঠনের দায়ের করা মামলায় বৃহস্পতিবার ২১ জুলাইয়ের সভা নিয়ে শাসক তৃণমূলের আইনজীবীদের উদ্দেশে বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ বলেছেন, ‘‘আগামী বছর থেকে শহিদ মিনার, ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড বা অন্য কোথাও সভা করা যায় কি না, সেটা আপনাদের ভাবতে হবে।’’ যদিও এটি আদালতের পর্যবেক্ষণ। নির্দেশনামায় তার কোনও উল্লেখ নেই। নির্দেশনামায় কলকাতা পুলিশকে কিছু শর্ত দিয়েছে আদালত। সোমবার কাজের দিনে জনতাকে যাতে ভোগান্তির মধ্যে না-পড়তে হয়, তা নিশ্চিত করতে কলকাতা পুলিশকে একগুচ্ছ শর্ত দিয়েছে হাই কোর্ট। আদালতের এ ধরনের নির্দেশ অতীতে দেখা যায়নি।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সভা করেছিলেন ধর্মতলায় ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনের রাস্তায়। সেই সভার অনুমতি পেতে বিজেপি-কে (পড়ুন শুভেন্দু অধিকারীকে) আদালতে আবেদন জানাতে হয়েছিল। সেই মামলাতেও ২১ জুলাইয়ের প্রসঙ্গ উঠেছিল। আদালত বলেছিল, অন্যদের সভায় যানজট তৈরি হলে ২১ জুলাইয়ের সভাও বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হবে। আদালতের ওই পর্যবেক্ষণের পরে অবশ্য কলকাতা পুলিশ বিজেপি-কে সভা করার অনুমতি দিয়েছিল। ২০১৬ সালেও একই উপমা দিয়ে ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে সভা করার অনুমতি আদালত থেকে আদায় করেছিল বিজেপি। বামেদের আইনজীবী সংগঠনের দায়ের করা মামলারও মূল বিষয় ছিল, ২১ জুলাই ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে তৃণমূলের সভা হতে পারলে অন্য রাজনৈতিক দলকেও সেখানে অনুমতি দিতে হবে। অতীতে আদালত ‘গণতান্ত্রিক অধিকারের’ প্রশ্নে নির্দেশ দিয়েছিল। এ বারের পর্যবেক্ষণে মৌলিক হয়ে উঠেছে জনতার ভোগান্তির প্রশ্ন, যা আগে দেখা যায়নি।
আনুষ্ঠানিক ভাবে আদালতের নির্দেশ বা পর্যবেক্ষণ নিয়ে কোনও মন্তব্য না-করলেও রাজনৈতিক দলগুলি বিশেষ খুশি নয়। একান্ত আলোচনায় নেতারা বলছেন, এর ফলে কর্মসূচি করার অধিকারই খর্ব হতে পারে। বিষয়টি আদালত সংক্রান্ত বলেই তাঁরা এ নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতেও রাজি নন। যেমন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘আদালতের উপর আমার কোনও মন্তব্য নেই।’’ তবে তিনি আরও বলেন, "সন্ধেবেলা সানগ্লাস পরে বিচার না-করাই শ্রেয়। ২১ জুলাইয়ের সঙ্গে আর পাঁচটা কর্মসূচি কখনও এক হতে পারে না।’’ বিজেপি মুখপাত্র রাজর্ষি লাহিড়ী বলেন, ‘‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ম সবার জন্য এক হওয়া উচিত।’’ সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘আমরা ২১ জুলাই তৃণমূলের সভার বিরুদ্ধে নই। কিন্তু তৃণমূল সভা করলে বাকিদেরও সেই অধিকার আছে।’’
সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই নির্দেশ এবং পর্যবেক্ষণকে স্বাগত জানানো উচিত। কারণ আমরা দেখতে পাই কাজের দিনে এই ধরনের কর্মসূচি হলে সাধারণ মানুষের জীবনে নানা রকম বিপর্যয় ঘটে। তা কাম্য নয়।’’ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘বছরের পর বছর ধরেই এই জিনিস হয়ে আসছে। এখন আদালতের সৌজন্যে যদি ছবিটা পাল্টায় তা হলে তো ভালই হয়।’’ আদালতের পর্যবেক্ষণকে স্বাগত জানাচ্ছে একাধিক নাগরিক সংগঠন। কলকাতা-হাওড়া অফিসযাত্রী সমিতির সভাপতি সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাস্তা আটকে রাজনৈতিক দলগুলির মিছিল-মিটিং বাংলা তথা কলকাতার সংস্কৃতি। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে আসলে দুর্ভোগে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। সার্বিক ভাবে এর প্রভাব পড়ে কর্মসংস্কৃতির উপরেও। আদালতের এই পর্যবেক্ষণ থেকে দলগুলির শিক্ষা নেওয়া উচিত।’’
সোমবার ধর্মতলায় তৃণমূলের মহাসমাবেশ। দেখার বিষয় জনজীবন, রাস্তাঘাট স্বাভাবিক রাখতে আদালতের দেওয়া শর্তগুলি কী ভাবে পালন করে প্রশাসন, কী ছবি তৈরি হয় কলকাতার।