Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

ব্রিগেডের ময়দান: ধর্মক্ষেত্র এবং কুরুক্ষেত্র

রাজনৈতিক দলগুলির কাছে সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শন এবং জনসমর্থন দেখানোর সবচেয়ে বড় পরিসর হল ব্রিগেড।

১৯৯২ সালে ব্রিগেডের সমাবেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র

১৯৯২ সালে ব্রিগেডের সমাবেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র

স্যমন্তক ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:৪৩
Share: Save:

আকার-আয়তনে এ বারের ব্রিগেড কত বড় হবে, তা নিয়ে চলছে জোর জল্পনা। ইতিমধ্যেই যে ভাবে মানুষের ঢল নেমেছে শহরে, তাতে অনেকেই দেখছেন ‘ইতিহাসের’ হাতছানি। অনেকরই উৎসুক ভাবনা, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি নিজেই নিজের রেকর্ড ভাঙবেন? যেমন ১৯৯২ সালে প্রদেশ যুব কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে মমতার ব্রিগেড, ২০১১-এ তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে বিজয় সমাবেশের ব্রিগেড, ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে ব্রিগেড।

রাজনৈতিক দলগুলির কাছে সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শন এবং জনসমর্থন দেখানোর সবচেয়ে বড় পরিসর হল ব্রিগেড। ডান-বাম সকলেই তাই বারবার ব্রিগেডে এসে নিজেদের ‘জাহির’ করার চেষ্টা করে। ব্রিগেড এ ভাবেই রাজ্য রাজনীতির গত কয়েক দশকের ইতিহাসের সাক্ষী।

স্বাধীনতার আগে এই মাঠে কোনও রাজনৈতিক সমাবেশের অনুমতি ছিল না। কেবলমাত্র সেনার অনুষ্ঠানই হত। ১৯১২ সালে পঞ্চম জর্জ সেনার অনুষ্ঠানে এসেছেন। তবে ১৯১৯ সালের ৬ এপ্রিল ব্রিগেডের অনতি দূরে শহিদ মিনারের কাছে রাউলাট আইনের প্রতিবাদে রাজনৈতিক সভা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ-সহ একাধিক নেতা।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালের ব্রিগেড এবং ময়দানের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গিয়ে কোনও কোনও ইতিহাসবিদ লিখেছেন— মহাকরণ, রাজভবন, বিধানসভা যখন রাজ্য পরিচালনার কেন্দ্র, তখন তার সামান্য দূরে এসপ্লানেড ইস্ট, শহিদ মিনার এবং ব্রিগেড ক্রমশ হয়ে ওঠে প্রতিবাদ জানানোর ময়দান।

ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, ব্রিগেডে প্রথম রাজনৈতিক সভা করেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ১৯৪৯ সালের ১৪ জুলাই। শহর জুড়ে তখন ১৪৪ ধারা। শুধু ওই সভার জন্য ২ ঘণ্টা কার্ফু শিথিল হয়। কিন্তু তাতেও বিশৃঙ্খলা এড়ানো যায়নি। বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় এক পুলিশকর্মীর। পরদিনের খবরের কাগজ লিখছে, অন্তত ১০ লক্ষ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমাগম হয়েছিল সেখানে। এর পরে একাধিক বার জনসভার জন্য ব্রিগেডকে বেছে নিয়েছেন নেহরু।

তবে শুধুই রাজনৈতিক সমাবেশ নয়, রাষ্ট্রনেতারা তখন ব্রিগেডকে ব্যবহার করতেন বিদেশি অভ্যাগতদের সংবর্ধনা দেওয়ার জন্যেও। ১৯৫৫ সালের ২৯ নভেম্বর ময়দানে সোভিয়েত রাশিয়ার তৎকালীন প্রধান নিকোলাই বুলগানিন ও রুশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান

নিকিতা ক্রুশ্চেভকে সংবর্ধনা দেন প্রধানমন্ত্রী নেহরু। ছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ও। তখনকার সংবাদপত্র লিখেছিল, বিপুল জনসমাগম দেখে নেতারা তো বটেই, চমকে গিয়েছিলেন আগত কেজিবির গোয়েন্দারাও।

’৭২ সালে বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার পরে ব্রিগেডে ইন্দিরা-মুজিবের সমাবেশও ‘ঐতিহাসিক’ মাত্রা পায়। কত লক্ষ লোক হয়েছিল, সেই হিসেব ছিল আকাশ ছোঁয়া। তার আগে, ১৯৫৬ সালের ৯ ডিসেম্বর চিনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাইকে এই মাঠেই আপ্যায়ন করেছিলেন বিধান রায়। তবে ভিড়ের নিরিখে তা অত ব্যাপক ছিল না। ’৮৬-র ফেব্রুয়ারিতে ব্রিগেডে এসেছিলেন পোপ দ্বিতীয় জন পল। কোন‌ও ধর্মীয় নেতার ধর্মীয় সমাবেশ এর পরে আর হয়নি।

জওহরলাল ব্রিগেডে শেষ বার বক্তৃতা করেন ১৯৬৩ সালের ২ জুলাই। এর ঠিক এক বছর পরে ’৬৪ সালের ৯ জুন স্পেশ্যাল ট্রেনে নেহরুর চিতাভস্ম এনে ব্রিগেডে রাখা হয়। সারা রাত ধরে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পন করেন জনসাধারণ।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গাঁধী প্রথম ব্রিগেডে বক্তৃতা করেন ’৬৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। ইতিমধ্যেই উত্তপ্ত হতে শুরু করে রাজ্য-রাজনীতি। ’৬৭ সালের নভেম্বরে সদ্য গঠিত যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা বাতিল হয়। তৈরি হয়, প্রফুল্ল ঘোষের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের মন্ত্রিসভা। এরই প্রতিবাদে ২২ নভেম্বর ব্রিগেডে সভা করেন যুক্তফ্রন্ট নেতৃত্ব। সভায় ব্যাপক লাঠি চালায় পুলিশ। আহত হন প্রাক্তন মন্ত্রীরা।

এর বছরখানেকের মধ্যে ’৬৯-এর ফেব্রুয়ারিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে যুক্তফ্রন্ট। ২৩ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেডে বিজয় উৎসব পালন করে বামফ্রন্ট। আবার সে বছর মে মাসেই ময়দান প্রথম দেখে নকশাল নেতা কানু সান্যালকে। সভা ঘিরে হাঙ্গামাও এখনও স্মৃতিতে আছে অনেকের।

১৯৭৫ সালে ব্রিগেডের ময়দান প্রথম শোনে জনতা দলের নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণকে। এর দু’বছর পরে ’৭৭-এর ফেব্রুয়ারিতে এই ময়দানেই জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করবেন জয়প্রকাশ। ’৭০ থেকে ক্ষমতাচ্যূত হওয়া পর্যন্ত ব্রিগেডে সবচেয়ে বেশি সভা করেছে বামেরা। কংগ্রেস বরাবরই মূলত প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ব্রিগেডের আয়োজন করেছে। অনেকেই বলেন, রাজ্য স্তরের নেতাদের নিয়ে ব্রিগেড ভরানোর ‘ঝুঁকি’ নেয়নি প্রদেশ দল। প্রধানমন্ত্রীকে না এনে যুব কংগ্রেসের পতাকায় প্রথম ব্রিগেড সমাবেশ করেন মমতাই। ডাক দেন ‘বামফ্রন্টের মৃত্যু ঘণ্টা’ বাজানোর।

জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামেদের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সভা ময়দানে ১৯৮৮-র ‘বিরোধী কনক্লেভ’। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ, জ্যোতি বসু, অটলবিহারী বাজপেয়ী হাতে হাত ধরে ডাক দিয়েছিলেন— ‘রাজীব হঠাও’। অনেকেই যে কনক্লেভের সঙ্গে তুলনা করছেন মমতার এ দিনের ব্রিগেডের।

’৯০ সালে প্রথম ব্রিগেডে সমাবেশ করে বিজেপি। এসেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণীরা। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদীর ব্রিগেড সমাবেশে মঞ্চের মুখ ঘুরিয়েও মাঠ ভরানো যায়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE