আগেই অবস্থান বদলে কাটোয়ায় প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জমি কেনার ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিল প্রশাসন। রাজ্য সরকারের হাতে থাকা প্রায় ১০০ একর জমি এনটিপিসির হাতে তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার কাটোয়া মহকুমাশাসকের দফতরে রাজ্য পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ পরিচালিত জন-শুনানিতে যোগ দিলেন তৃণমূলের দুই বিধায়ক, রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, শেখ সাহানেওয়াজও। রাজনৈতিক মহলের দাবি, দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছ থেকে সবুজ সঙ্কেত পেয়েই জন-শুনানিতে যোগ দিয়েছিলেন ওই দু’জন।
এমনিতে প্রস্তাবিত এই তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জমিজট দীর্ঘ দিনের। ১৩২০ মেগাওয়াটের এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ৯১১ একর জমি প্রয়োজন। যার অর্ধেকের বেশি জমি (৫৫৬ একর) বাম আমলেই অধিগ্রহণ করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের হাতে থাকা জমি বাদ দিলে এই প্রকল্পের জন্য এনটিপিসিকে আর মাত্র ১৫০ একর জমি কিনতে হবে। যার মধ্যে ৬৮ একর জমির মালিকের সঙ্গে লিখিত-চুক্তিও করেছে এনটিপিসি। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে শিলিগুড়ি থেকে কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের হাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ১০০ একর জমি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। পরে ১০ জুন রাজ্য সরকারের সবুজ সঙ্কেত পেয়ে কাটোয়ার মহকুমাশাসক মৃদুল হালদার জমি কেনার ব্যাপারে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন। সেখানে নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে জমির দাম দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়।
এ দিন চাষিরা জমি কেনা নিয়েই প্রশ্ন করেন শুনানিতে। কোশিগ্রামের জমির মালিক অরূপ ঘোষ বলেন, “অক্টোবর মাসে আমাদের সঙ্গে এনটিপিসি জমি কেনার চুক্তি করেছিল, আট মাস কেটে গেল কিন্তু জমি কেনার ব্যাপারে এক ছটাকও এগোয়নি। কিছু কিছু জমির মালিক বলছেন, চুক্তি তো শেষ হয়ে গেল, এ বার কী হবে?” সভায় যোগ দিতে আসা রাজুয়া গ্রামের মহম্মদ জাহিরুদ্দিন, বাননাগরা গ্রামের পূর্ণেন্দুশেখর চক্রবর্তী কিংবা পারুলিয়া গ্রামের মনিময় মণ্ডলেরাও বলেন, “এই প্রকল্প নিয়ে গোড়া থেকেই দোলাচলে ভুগছেন এলাকার মানুষ। প্রকল্পটি আদৌ হবে কি না, কিংবা কবে হবে সেটাই প্রশ্ন।’’ অনিশ্চয়তার সুরে শ্রীখণ্ড পঞ্চায়েতের কংগ্রেস প্রধান দীপক মজুমদারও বলেন, “এমনিতেই পিছিয়ে রয়েছি, আমরা চাই তাড়াতাড়ি প্রকল্পটি গড়ে উঠুক।”
এনটিপিসি-র কর্তাদের অবশ্য আশ্বাস, পুজোর আগেই জমি কেনার জন্য মাঠে নেমে পড়তে পারবেন তাঁরা। ওই সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, জমির ঊর্ধ্বসীমা তোলার জন্য নির্দিষ্ট ফর্মে (১৪ ওয়াই) অনেকদিন আগেই আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারের জমিগুলির জন্য নতুন করে পঞ্চায়েত ও বিভিন্ন দফতরের ‘নো অবজেকশন’ জমা দিতে হচ্ছে ভূমি অধিগ্রহণ দফতরে। ফলে নতুন করে জমি কেনার অনুমতি মিলছে না। তবে পুজোর আগেই পরিস্থিতি বদলাবে বলে তাদের আশা। বৈঠকে হাজির সংস্থার কাটোয়া প্রকল্পের জেনারেল ম্যানেজার অভিজিৎ সেন বলেন, “পরিবেশ মন্ত্রকের নিয়ম মেনেই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হবে। জমিহারা পরিবারেরা যাতে কাজ পান তার জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আপনারা আস্থা রাখুন, প্রকল্প কাটোয়াতে হচ্ছেই। বিভিন্ন কারণে দেরি হওয়ার জন্য আমরা দুঃখিত।” সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৮ সালে রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম বা পিডিসিএল এই প্রকল্পের জন্য পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড় পেয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে প্রকল্প গড়ে ওঠে নি। ফলে পরিকল্পনা পাল্টানোর জন্য ফের কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ দফতরের কাছে আবেদন করতে হয়েছে এনটিপিসিকে।
আশ্বাস পেয়ে আশার আলো দেখছেন গ্রামবাসীরাও। গোয়াই গ্রামের রবিন মজুমদার বলেন, ‘‘প্রকল্পের সুফল গ্রামের মানুষ সরাসরি পাবেন তার নিশ্চয়তা পেলে, জমি এনটিপিসিকে দেওয়া নিয়ে কারও আপত্তি থাকবে বলে মনে হয় না।” এনটিপিসির দফতরে দীর্ঘদিন কম্পিউটার শিখেছেন আনহারা খাতুন, দোলন রায়েরা। তাঁরাও বলেন, “এখনও কিছুই হয়নি, তার মধ্যেই আমাদের মতো কত মেয়ে উপকার পেয়েছি। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে আরও কত লাভ হবে, তা সবার ভেবে দেখা দরকার।” কাটোয়ার বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও কেতুগ্রামের বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজও বলেন, “প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার পথে এগোচ্ছে। সামগ্রিক স্বার্থে এই প্রকল্পের জন্য এগিয়ে আসতে হবে।” সভায় হাজির অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি সংস্কার) অশোক সাহা বলেন, “প্রকল্পটি হলে কাটোয়ার সামগ্রিক উন্নয়ন হবে।” ইতিমধ্যে বর্ধমান–কাটোয়া রেলপথের জন্য ১১২ কোটি টাকা এবং কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালের জন্য ২৫ কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এনটিপিসি।