প্রথম দরবার: রজনী সেন রোড
বছর শেষের লুটিয়েন্স দিল্লির ঠান্ডা কলকাতার রজনী সেন রোডে এসে অনেকটাই ফিকে। তার উপরে উৎকণ্ঠা বোধ হয় রক্তচাপ বাড়িয়ে দিয়েছে সিবিআই অধিকর্তা রঞ্জিত সিন্হার। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। ভোরের উড়ানে দিল্লি থেকে পৌঁছেছেন দমদমে। আর সেখান থেকে সটান প্রদোষ সি মিটার ওরফে ফেলুদার বাসায়।
আগের দিনই ফোনে মোদ্দা বিষয়টি বলা ছিল। লাল ডায়েরির হাই প্রোফাইল কেস নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে বলেই বোধহয় ফেলুদা ঘড়ি ধরে বিশ মিনিট আগে উঠে স্নান-যোগব্যায়াম সেরে তৈরি। বাইরে গাড়ির শব্দ পেতেই, তোপসেকে চাপা গলায় বলল, “শ্রীনাথকে চা-টা বলে আয়। আর কাল নিউমার্কেট থেকে যে ডালমুট আনা হল, সঙ্গে সেটাও আনতে বলিস।”
রঞ্জিত ঘরে ঢুকলেন। আর মাত্র এক দিন চাকরির মেয়াদ রয়েছে তাঁর। শেষ বেলায় এই নতুন ফ্যাসাদে তাঁকে বেশ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। ফেলুদা নিজেই বলল, “আপনি স্বচ্ছন্দে চামড়ার জ্যাকেটটা খুলে পাশে রাখতে পারেন।”
দিল্লিতে এই মুহূর্তে যত দাপাদাপি এক লাল ডায়েরি নিয়ে। আগের দিন লালমোহনবাবুও টিভিতে সেটা দেখেছেন। ডায়েরিতে ‘সহারা’ লেখা দেখে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে ফেলুদাকে ফোন করেছিলেন। বলছিলেন, “তৃণমূল কি আমার সাহারায় শিহরন-এর সেকেন্ড পার্ট লিখে ফেলতে চাইছে নাকি মশাই? হাইলি সাসপিশাস! এটা তো কাল্টিভেট করতে হচ্ছে!”
কাল্টিভেট করার দায়িত্বটা যে শেষে ফেলুদার ঘাড়েই পড়বে, তা কে জানত! জ্যাকেট সোফায় রেখে খুব দ্রুত ফেলুদাকে গোটা কেসটা ব্রিফ করলেন রঞ্জিত। সোমবার সকালে সংসদ ভবনের মূল গেটের সামনে তৃণমূলের পঁচিশ জন সাংসদ একটি টকটকে লাল ডায়েরি নিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন। ডায়েরির প্রচ্ছদে লেখা ‘সহারা’। পরে লোকসভার ভিতরে ওয়েলে গিয়েও এই নিয়ে বিক্ষোভ দেখান তাঁরা। ওয়াকআউট করেন। ওই সাংসদদের দাবি, গত ২২ নভেম্বর সুব্রত রায়ের সহারা সংস্থার উত্তর ভারতের অফিসে তল্লাশি করে ১২০ পাতার একটি রহস্যময় লাল ডায়েরি পেয়েছে সিবিআই। বেআইনি ভাবে বাজার থেকে টাকা তুলেছেন, এমন অনেক নাম নাকি সেই ডায়েরিতে রয়েছে। লোকসভায় তৃণমূলের নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ওই ডায়েরিতে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের নাম রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে একটি নামের আদ্যক্ষর ‘এন এম’! সিবিআই কর্তা ফোনেই ফেলুদাকে জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে, গোপনে এই কেসটির সুরাহা করুক ফেলুদা। সেই কৈলাসে কেলেঙ্কারির সময় থেকেই ফেলুদার মগজাস্ত্রের উপরে ভারত সরকারের আস্থা অটুট।
ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়ে পরপর দু’টো ধোঁয়ার রিং ছাড়ল। রঞ্জিতবাবুকেও অফার করেছিল, উনি নিলেন না। বললেন, “মিস্টার মিটার, আগে কেস মিটুক! রিটায়ারমেন্টের মুখে কী ঝামেলা বলুন তো!” ফেলুদা বলল, “ডায়েরিটা কি সিবিআই সত্যিই পেয়েছিল?” রঞ্জিতবাবুর দাবি, সিবিআই এ রকম কোনও ডায়েরি পায়নি। তা হলে? “ডায়েরিতে কী রয়েছে, সে ব্যাপারে আপনাদের কোনও আন্দাজ আছে?” সিবিআই অধিকর্তা বললেন, “ওঁদের কাছে দেখতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন জানিয়েছেন, এটি মূল ডায়েরি নয়। এমনকী তার ফটোকপিও নয়। তৃণমূলের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, এটা নাকি প্রতীকী ডায়েরি।”
“এন এম বলতে ঠিক কার দিকে অভিযোগ তোলা হচ্ছে বলে আপনাদের ধারণা?”
“মিস্টার মিটার, দেশের প্রধানমন্ত্রীর দিকেই যে ইঙ্গিত করা হচ্ছে, এটা তো স্পষ্ট। এর পিছনে বিশেষ করে তৃণমূলের রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ রয়েছে। কিন্তু আমরা চাই নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। কারণ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আশঙ্কা, খুব শীঘ্রই একটি নকল ডায়েরি উপস্থিত করা হতে পারে সংসদে।” ফেলুদা কয়েকটা দিন সময় চেয়ে নিল। হ্যান্ড শেক আর আগাম ধন্যবাদ দিয়ে সিবিআই কর্তা বিদায় নিলেন। তাঁর গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ডিরেক্টরি থেকে কিছু নম্বর খুঁজতে শুরু করল ফেলুদা। বলল, এক বার সিধু জ্যাঠার কাছেও যাওয়া দরকার।
সিধু জ্যাঠা তো বটেই, কলকাতায় নিজের চেনাজানা কয়েক জন রাজনীতির লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলেও ফেলুদা কিন্তু নিশ্চিত, লাল ডায়েরির ‘রহস্য’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া আর কারও জানা নেই। গোপন সূত্রে ফেলুদা এ-ও জেনেছে, রবিবার কলকাতায় অমিত শাহের সভায় লোকসমাগম দেখেই নাকি লাল ডায়েরি ‘ফাঁস’ করার সিদ্ধান্ত নেন তৃণমূলনেত্রী। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। ভিক্টোরিয়া হাউসের সভা শেষ হতেই দলের এক প্রবীণ মন্ত্রীকে ডেকে মমতা দাবি করেন, কুণাল ঘোষ যেমন ৯১ পাতার ডায়েরি লিখেছেন, সহারা-প্রধান সুব্রত রায়ও একটি লাল ডায়েরিতে অনেক কিছু লিখেছেন। তাতে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহেরও নাম রয়েছে। ওই মামলার তদন্তকারী সংস্থা সেই ডায়েরি বাজেয়াপ্ত করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মতোই লাল ডায়েরির কথা সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। তিনি অবশ্য একটু ফাঁক রেখে বলেন, “এমন একটি ডায়েরি রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।”
দিদির নির্দেশে সোমবার সারা দিন ধরে এই ডায়েরি নিয়ে তৃণমূল সাংসদরা গলা ফাটিয়েছেন। কিন্তু কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারেননি, এই অভিযোগের ভিত্তি কী। দলের এক শীর্ষ নেতা দাবি করেন, লাল ডায়েরি নিয়ে এ দিন তাঁদের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেননি মমতা। ফলে আদৌ অভিযোগটি সারদার পাল্টা হিসাবে রাজনৈতিক চাপ তৈরির জন্যই করা হচ্ছে, নাকি এর কোনও সারবত্তা রয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। দলের মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছে, সারদা নিয়ে যখন জেরবার হচ্ছে দল, তখন এমন তাস হাতে থাকা সত্ত্বেও কেন তা এত দিন প্রকাশ করা হয়নি? দলের কেউ কেউ আবার জানান, সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এতটাই চাপে যে, সহারার সঙ্গে বিজেপির যোগাযোগের অভিযোগ তুলে তিনি মরিয়া প্রত্যাঘাত করতে চাইছেন। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে বলেই আশঙ্কা করছেন ওই নেতারা।
“তোমাকে এত খবর কে দিল, ফেলুদা?” তোপসে জিজ্ঞেস করতেই ফেলুদা গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, “বেশি কথা বললে গাঁট্টা খাবি।”
তবে এটুকু জানা গেল যে, সিধু জ্যাঠা ফেলুদাকে বলেছেন নয়ের দশকের শেষ দিকে হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে এমনই এক ‘জৈন ডায়েরি’র কথা উঠে এসেছিল। সেই ডায়েরিতে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর নাম রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। আডবাণী সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে লোকসভা থেকে পদত্যাগ করে ঘোষণা করেছিলেন, যত দিন না তিনি অভিযোগমুক্ত হচ্ছেন, তত দিন নির্বাচনে লড়বেন না। পরবর্তী কালে হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে আডবাণীর কোনও যোগাযোগ প্রমাণিত হয়নি। জৈন ডায়েরিতেও তাঁর নাম ছিল না।
গত পনেরো-বিশ বছর ধরে দিল্লিতে সংসদীয় অধিবেশন ‘কভার’ করে আসছেন, এমন বেশ কিছু সাংবাদিককে চেনে ফেলুদা। যাঁরা স্পিকারের সামনের টেবিলে বসে নোট নেন, তাঁদের মধ্যেও এক জনকে চেনে ও। তাদের সঙ্গে কথা বলতে ফেলুদা এক বেলার জন্য দিল্লি ঘুরে এল। জানা গেল, যে ডায়েরিগুলি সোমবার সংসদে আনা হয়েছিল, সেগুলি সব ক’টিই ছিল সংসদীয় ডায়েরি। অর্থাৎ সংসদের তরফ থেকে বছরের শুরুতেই যে ডায়েরি সাংসদদের উপহার দেওয়া হয়। ৩৫টি এ রকম ডায়েরি একত্র করেন তৃণমূলীরা। তার পর সেগুলিকে লাল রঙের মার্বেল পেপার দিয়ে মলাট দেওয়া হয়। উপরে লেখা হয় ‘সহারা’র নাম।
দিন কয়েক পরের সকাল। এ বার এসে হাজির নতুন সিবিআই অধিকর্তা। ‘‘মিস্টার মিটার, কিছু হল?’’ চারমিনার ধরিয়ে ফেলুদা বলতে থাকে, “এখনও পর্যন্ত যা মনে হচ্ছে, এমন কোনও ডায়েরি যদি থেকেও থাকে, তা হলেও তা অন্তত অভিযোগকারীদের হাতে নেই। সংসদীয় অধিবেশন চলবে ২৩ তারিখ পর্যন্ত। যদি সত্যিই ডায়েরি থাকত, তা হলে তা নিয়ে এক বিরাট আন্দোলনে যাওয়ার সুযোগ পেত তৃণমূল। শত্রুপক্ষের মারাত্মক কোনও দুর্বলতার খবর যদি হাতে আসে, তা হলে স্বাভাবিক প্রবণতা হল পাকা প্রমাণ হাতে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা। আধপাকা খবর নিয়ে প্রচারে নামলে শত্রুপক্ষ আসলে সাবধানই হয়ে যায়। ফলে বুঝতেই পারছেন...!”
কথা অসমাপ্ত রেখে আর একটি ধোঁয়ার রিং ছাড়ে ফেলুদা। বলে, “তবু শেষ কথা আজই বলছি না। আর কয়েকটা দিন যাক!”
দ্বিতীয় দরবার: হ্যারিসন রোড
স্ত্রী সত্যবতী আর খোকাকে নিয়ে শ্যালক সুকুমার শীতের ছুটি কাটাতে পশ্চিমে গিয়েছে। ফলে হ্যারিসন রোডের বাড়িতে ব্যোমকেশের অখণ্ড অবসর। তক্তপোষের উপর দাবায় নিমগ্ন সে আর অজিত। ব্যোমকেশ যে কিনা দাবা খেলতে জানতই না, এখন প্রায় সব খেলায় মাত করে অজিতকে। আজও হয়তো তার অন্যথা হতো না, যদি না দরজায় আচমকা কড়া নড়ে উঠত ভরদুপুরে। রাজনীতির দাবা যে খাস রাজধানী থেকে ব্যোমকেশের তিনতলার বৈঠকখানায় এ ভাবে হুড়মুড় করে ঢুকে আসবে, তা একটু আগেও বোঝা যায়নি।
সরকার বাহাদুরের পাইক-পেয়াদা নিয়ে ব্যোমকেশের দোরগোড়ায় হাজির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু! বিষয়, লাল ডায়েরি রহস্য। তৃণমূলের সংসদীয় দল দিল্লিতে আন্দোলনে নেমেছে। তাদের দাবি, সহারার অফিসে সিবিআই-এর তল্লাশিতে একটি লাল ডায়েরি পাওয়া গিয়েছে, যেখানে কি না বেআইনি আর্থিক লেনদেনের তালিকায় নাম রয়েছে অমিত শাহ এবং ‘এন এম’ আদ্যক্ষরযুক্ত এক ব্যক্তির! সেই ডায়েরি লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সরকার হয়রান। তাই শরণাপন্ন হতে হয়েছে সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীর।
এটা ঠিক যে গত কয়েক মাস ধরে ব্যোমকেশের কাজকর্মে একটু মন্দা যাচ্ছিল। তবে এমন পর্যায় তার গোয়েন্দা জীবনে বেশ কয়েক বার এসেছে। কিন্তু এ বারের দীর্ঘ কর্মহীন জীবনের মধ্যে এই লাল ডায়েরির রহস্য যেন কিছুটা অক্সিজেনবৎ। বেঙ্কাইয়ার সঙ্গে আলোচনায় ঘটনাটি নোট করে নিল ব্যোমকেশ। প্রয়োজনীয় তথ্য এবং টেলিফোন নম্বরগুলিও জেনে নিল। তার পর বলল, “তদন্তের কাজে দিল্লি যেতে হবে বলে মনে হয় না। আমার ধারণা এই রহস্যের জট লুকিয়ে রয়েছে কলকাতাতেই। দেখা যাক কী করতে পারি।”
ব্যোমকেশের কাছে আসার আগে রহস্যময় লাল ডায়েরির এক প্রস্ত ‘তদন্ত’ অবশ্য সেরে রেখেছেন নরেন্দ্র মোদী সরকারের সংখ্যালঘু ও সংসদীয় দফতরের প্রতিমন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি। বললেন, “আমি তো দেখতে চাইলাম ডায়েরি। বললুমও সকলকে দিয়ে সই করিয়ে সংসদে জমা দিন। কিন্তু ডায়েরি দেখতে গেলেই পালাচ্ছেন তৃণমূল সাংসদরা। শুধু হট্টগোল বাধানোই লক্ষ্য। আর কিছু নয়।” এরই মাঝে মুলায়ম সিংহ যাদবও কিছুটা ভয়ে ভয়ে ডায়েরিতে উঁকি মেরে এসেছেন। ডায়েরি ফাঁকা দেখে মুচকি হেসে নিশ্চিন্তে ফিরে যান।
মোদী সরকারের সংসদীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া সোমবার সংসদ ভবনেই একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, “রবিবার কলকাতায় অমিত শাহের জনসভা দেখে ভয় পেয়েছেন মমতা। কিন্তু এ সব ফন্দি কাজে আসবে না। মোদীকেও আপনারা ‘ধোঁকাবাজ’ বলছেন! যত যা-ই হোক, নরেন্দ্র মোদী দেশের প্রধানমন্ত্রী।” এমনকী অমিত শাহের সচিব শ্রীকান্ত শর্মাও বলেছেন, “বিজেপির জনপ্রিয়তা বাড়তে দেখে মমতার ঘুম ছুটেছে। নিজের পায়ের তলায় জমি যত খসছে, বিজেপির বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলছেন। দেশের নিরাপত্তা শিকেয় তুলে অপরাধীদের বাঁচাচ্ছেন।”
তবু সত্যান্বেষণে ফাঁক রাখতে চায় না সরকার। তাই তারা সত্যান্বেষীর ঘরে।
দিল্লির অতিথিদের সামনে সিগারেটের টিন খুলে এগিয়ে ধরল ব্যোমকেশ। বহু দিনের সঙ্গী অজিত টের পেল এ বার টানা কয়েক দিন আর কোনও কথা মুখ থেকে বার করা যাবে না ব্যোমকেশের। রহস্যভেদ না করতে পারলে, তার স্বাভাবিকতা ফিরবে না। অতিথিরা চলে যাওয়ার পরেই চট করে পাঞ্জাবিটা গলিয়ে নিল ব্যোমকেশ। “আমার ফিরতে হয়তো একটু রাত হবে ভায়া। বাইরেই খেয়ে নেব। তুমি অপেক্ষা করো না।” অজিতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চামড়ার গ্রিসান স্যান্ডেলটি গলিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল সে।
ব্যোমকেশ কত রাতে বাড়ি ফিরেছে সেটা ঠিক জানে না অজিত। পরের দু’দিন একই রকম রুটিন। সকালে বেরিয়ে যাচ্ছে, ফিরছে রাত করে। এক দিন অবশ্য অজিতকে সঙ্গে নিয়েই বেরলো ব্যোমকেশ। আর কিছুটা স্বগতোক্তির স্বরেই বলল, “যে ব্যক্তি স্বভাবতই নির্বোধ, সে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করবে এটা সম্ভব নয়। আবার যে ব্যক্তি বুদ্ধিমান, সে বোকামির ভান করবে এটা খুবই সম্ভব।” পাল্টা প্রশ্ন করল না অজিত, কারণ সে জানে এখন কোনও উত্তরই পাওয়া যাবে না। দক্ষিণ কলকাতায় একটি বড় বাড়ির সামনে এসে অজিত বুঝতে পারল যে, এটি এক প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতার বাড়ি। যিনি লাল ডায়েরি নিয়ে সরব হয়েছেন। কিন্তু এই ভর দুপুরে তাঁর তো বাড়ি থাকার কথা নয়। তা হলে?
অজিতকে বাইরে দাঁড়াতে বলে সটান বাড়ির ভিতরে চলে গেল ব্যোমকেশ। বলে গেল, সতর্ক হয়ে অপেক্ষা করতে। আধ ঘণ্টা পর যখন নেমে এল, তখন সে শিস দিচ্ছে। রহস্যভেদের উত্তেজনায় চকচক করছে চোখ। সোজা বাড়িতে এসে তক্তপোষে চিৎ হয়ে শুয়ে পুঁটিরামকে খাবার আনতে পাঠিয়ে অজিতকে বলল, “সন্ধ্যায় এখানে দিল্লির লোকজন আসবে। তাঁদের বলার আগেই তোমার কৌতূহলটা প্রশমিত করে দিই, কেমন? এটাকে একটা ড্রেস রিহার্সালও বলতে পারো।”
সিলিং-এ পাখার দিকে তাকিয়ে একটানা বলতে থাকল ব্যোমকেশ, তার গত ক’দিনের রহস্যভেদের ঘটনা। “দিল্লিতে বেশ কয়েক জায়গায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে সকাল এবং বিকাল একই দিনে মাত্র ছ’সাত ঘণ্টার ব্যবধানে অভিযোগকারী রাজনৈতিক দলটি (এ ক্ষেত্রে তৃণমূল) তাদের বক্তব্যের একটি মূল জায়গা পরিবর্তন করেছে। তারা যখন সংসদে ঢোকার মূল গেটের সামনে স্লোগান দিচ্ছিল, তখন বলা হচ্ছিল, সিবিআই-এর তল্লাশিতে এই লাল ডায়েরি পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু বিকেলের পরেই তৃণমূলের বক্তব্য বদলে যায়। দলের তরফ থেকে খোঁজ নিয়ে দেখা হয়, (সম্ভবত কারও খটকা লাগার ফলেই) ২২ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে সহারা সংস্থায় কোনও সিবিআই তল্লাশিই হয়নি। হয়েছিল, ইনকাম ট্যাক্সের তল্লাশি! এই দু’টো যে এক নয়, সেটা তো এক জন শিশুও বোঝে। তা হলে সাংসদেরা এত বড় ভুলটা করলেন কী করে?” টিন থেকে সিগারেট বার করার জন্য একটু দম নিল ব্যোমকেশ।
তার পর আবার বলতে শুরু করল, “এই সূত্রটি থেকেই আমার মনে খটকার জন্ম নেয়। তার পর জানতে পারি এই লাল ডায়েরি নিয়ে আন্দোলনের কৌশল তৈরি হয়েছিল কলকাতাতেই। তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের নির্দেশে। যখন দিল্লিতে ধর্না চলছে, তখন বাংলাতেও একই অভিযোগে সরব হন তৃণমূলেরই এক মন্ত্রী। ফলে আমার মনে হয় ওই মন্ত্রীর অন্দরমহলে খবর নিলে হয়তো সত্যটা জানা যেতে পারে। হলও তা-ই।”
ব্যোমকেশ বলে চলে, “খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, হঠাৎই তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রীর পক্ষ থেকে ওই নেতার প্রতি ফরমান জারি হয় এমন একটা ডায়েরির কথা তুলে নরেন্দ্র মোদীকে বিঁধতে হবে, যা কুণাল ঘোষের লেখা সারদা অভিযোগ সংক্রান্ত ডায়েরির পাল্টা হয়! বিস্মিত নেতাটি জানতে চান, কীসের ভিত্তিতে এমনটা বলছেন নেত্রী? কিন্তু নেত্রী তা স্পষ্ট করেন না। বরং দাবি করেন, এমন একটি ডায়েরি আছে, এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত! এমনকী নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও নানা রকম প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয়। কী করা উচিত বুঝতে না পেরে, বিভ্রান্ত ওই নেতা তখন তাঁর স্ত্রীর পরামর্শ চান। বুঝতেই পারছ অজিত, এক জন আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্না নারী অন্য নারীর অবমাননা মেনে নিতে পারেন না। নেতার স্ত্রী তাই এই সব প্রচার না-করতে অনুরোধ করেন তাঁর স্বামীকে। আর এই বামা উদ্যোগে, শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র লাল ডায়েরিতেই সীমাবদ্ধ থাকে প্রচার। সহজবোধ্য যে এর মধ্যে কোনও সত্যতা নেই।”
ব্যোমকেশের কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় কড়া নড়ে ওঠে। তক্তপোশ থেকে গা ঝেড়ে উঠে ব্যোমকেশ বলে, “অজিত দরজা খুলে দাও। আমাদের দিল্লির অতিথিরা এসে গিয়েছেন!”
অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy