সইফুদ্দিন চৌধুরী ওরফে নাসপাতি। (ডান দিকে) সেই বাড়ি। নিজস্ব চিত্র।
এক সময় বেসরকারি বাসের কর্মী ছিলেন। কম্বলও ফেরি করতেন। কিন্তু এক-এক বার পঞ্চায়েত ভোট গিয়েছে, আর ‘চাকচিক্য’ বেড়েছে নাসপাতির— এমনই কানাঘুষো পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষে। কী করে এল বৈভব, তা নিয়ে নানা কথা শোনা যায় এলাকায়। তবে সে সব ফুঁয়ে উড়িয়ে নাসপাতির দাবি, যা করেছেন, তা নিজের দমেই।
খণ্ডঘোষের শাঁকারি ২ পঞ্চায়েতের তৃণমূলের উপপ্রধান সইফুদ্দিন চৌধুরীকে এলাকাবাসী ‘নাসপাতি’ নামেই বেশি চেনেন। তিনি তৃণমূলের শাঁকারি ২ অঞ্চল সভাপতি, আবার খণ্ডঘোষ ব্লকের সংখ্যালঘু সেল-এরও সভাপতি।
বাবা ছিলেন প্রান্তিক চাষি। মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়া নাসপাতি এক সময় তেলুয়া গ্রামের ভিতরে পৈতৃক পাকা বাড়িতে দাদা আলাউদ্দিন চৌধুরী ওরফে ‘বেদানা’র সঙ্গে যৌথ সংসারে ছিলেন। এখন গ্রামের সামনে সঙ্কীর্ণ রাস্তার উপরে তাঁর নিজের বাড়ি অনেকেরই নজর কাড়ে। নাসপাতির অবশ্য দাবি, “নিজের ১৫ বিঘা রয়েছে। আরও ৪৫ বিঘা জমি ভাগে নিয়ে বোরো ধানের বীজ তৈরি করে বিক্রি করি। ধাপে-ধাপে সে টাকাতেই সব করেছি।’’
১৯৯৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নাসপাতি ছিলেন বেসরকারি বাসের কর্মী। পরের পাঁচ বছর দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবারে কম্বল ফেরি করতেন। কিন্তু ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের হয়ে জেতার পর থেকেই তাঁর সম্পত্তি বাড়তে থাকে বলে শোনা যায় এলাকায় কান পাতলে। তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য মুখপাত্র দেবু টুডু বলেন, ‘‘আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি হলে, লোকে প্রশ্ন তুলবেই। আমাদের দলে কারও বিরুদ্ধে এমন প্রশ্ন উঠলে অবশ্যই দেখতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ সব ব্যাপারে খুব কড়া।’’
তৃণমূল সূত্রের দাবি, প্রথম বার উপপ্রধান হওয়ার পরে, ধাপে-ধাপে নাসপাতি ট্রাক্টর, গাড়ি, সাবমার্সিবল পাম্প এবং প্রায় ১৫ বিঘা জমি কেনেন। বছর পাঁচ-ছয় আগে, আড়াই-তিন কাঠা জমিতে গড়েন মুরগির খামার। ২০১৮-য় সংরক্ষণের জন্য নিজের গ্রামে পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়াতে পারেননি। দলও টিকিট দেয়নি। নির্দল হয়ে পাশের সংসদে ভোটে জিতে তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন। ফের উপপ্রধান হন। অতিমারির গোড়ার দিকে মুরগির খামার এবং আর একটু বেশি জমিতে বাড়ি তৈরি শুরু হয়। প্রায় ১৪০০ বর্গফুটের দোতলা বাড়ির অন্দরমহল মার্বেলময়। শোনা যায়, খরচ হয়েছে ৪০ লক্ষ টাকা। তবে নাসপাতির দাবি, ২০-২৫ লক্ষের বেশি খরচ হয়নি সব মিলিয়ে। স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার বছর ছেচল্লিশের এই নেতার। ছেলে অষ্টম শ্রেণি, মেয়ে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। স্ত্রী গৃহবধূ।
তৃণমূল সূত্রের দাবি, পঞ্চায়েতে যত বার উপপ্রধানের চেয়ারে বসেছেন, নাসপাতির সম্পত্তিও তত বেড়েছে। এলাকায় কান পাতলেই শোনা যায়, একশো দিনের কাজ থেকে শুরু করে, সরকারি আবাস যোজনা প্রকল্পের জন্য ‘প্রণামী’ দিতে হয় তাঁকে। ব্লকের এক নেতার আবার দাবি, “বর্ধমানের নবাবহাটে বালি খাদানের ইজারাদারদের সঙ্গে নাসপাতি বৈঠক করছেন, এমন ছবিও ভাইরাল হয়েছিল। কেন ওই বৈঠক, তা কি কেউ বোঝেন না!” কিন্তু তেলুয়া গ্রামের অনেকে এমনও বলছেন, “বিপদে-আপদে নাসপাতি পাশে থাকেন। সে জন্যই পাশের গ্রামে নির্দল হয়ে লড়েও ভোটে জিতেছেন।’’
কানাঘুষো উড়িয়ে নাসপাতি দাবি করেন, “আমাদের পঞ্চায়েতে বছরে এক কোটি টাকার কাজ করার জায়গা নেই। এখানে বালিখাদান বা ইটভাটাও নেই। সেখান থেকে আবার প্রণামী! হাস্যকর কথা।’’ তবে স্থানীয় সূত্রের খবর, পঞ্চায়েত এলাকায় না থাকলেও, লাগোয়া এলাকায় বালির ব্যবসার রমরমা রয়েছে। দলের অঞ্চল সভাপতি হিসেবে নাসপাতির প্রভাব ‘অনেক দূর’ ছড়ানো। ব্লক তৃণমূল সভাপতি অপার্থিব ইসলাম অবশ্য বলছেন, ‘‘এ সব আমার জানা নেই।’’
তা হলে বাড়ি-গাড়ি-ট্রাক্টর-সাবমার্সিবল পাম্প কী ভাবে হল? নাসপাতির দাবি, “প্রতি বিঘা জমিতে তৈরি বীজ বিক্রি করে ১৫ হাজার টাকা লাভ করি। ৬০ বিঘা বীজ বিক্রি করে কত টাকা আয় বুঝতে পারছেন? সেখান থেকেই সব কিছু করেছি। কে, কী বলল তাতে গুরুত্ব দেওয়া আমার কাজ নয়।’’ জুড়ে দেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল করি, সমাজসেবা করার জন্য। আর চাষ করি, আয় করার জন্য।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy