Advertisement
E-Paper

মান রইল না মুখ্যমন্ত্রীর

আক্রান্তকেই আক্রমণের নিশানা বানিয়ে পুলিশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই কিছু আছে। না হলে কি পুলিশ এমনি এমনি করবে সব!’ কিন্তু, পুলিশের কেস ডায়েরিতেই তেমন ‘কিছু’ পেল না আদালত! তাই শুক্রবার জামিন পেয়ে গেলেন সাত্তোরের নির্যাতিতা বধূ।

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৫ ১৭:১০
মুক্তি। সিউড়ি সংশোধনাগার থেকে বেরোতেই নির্যাতিতাকে জড়িয়ে ধরলেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়।

মুক্তি। সিউড়ি সংশোধনাগার থেকে বেরোতেই নির্যাতিতাকে জড়িয়ে ধরলেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়।

আক্রান্তকেই আক্রমণের নিশানা বানিয়ে পুলিশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই কিছু আছে। না হলে কি পুলিশ এমনি এমনি করবে সব!’ কিন্তু, পুলিশের কেস ডায়েরিতেই তেমন ‘কিছু’ পেল না আদালত! তাই শুক্রবার জামিন পেয়ে গেলেন সাত্তোরের নির্যাতিতা বধূ।

অথচ তাঁর জামিন আটকাতে এ দিন সর্বশক্তি দিয়ে আদালতে ঝাঁপিয়েছিল সরকারপক্ষ। যেন মুখ্যমন্ত্রীর কথাকেই সত্যি প্রতিপন্ন করতে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এবং অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) আদালতের কাছে নির্যাতিতাকে অত্যন্ত ‘বিপজ্জনক’ ও ‘প্রভাবশালী’ বলে প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টা চালালেন! কেন সাত্তোরের বধূকে জামিন দেওয়া ঠিক হবে না, তার সওয়াল করতে গিয়ে দুই সরকারি আইনজীবী কার্যত ব্যক্তিগত পর্যায়ে আক্রমণ শানালেন নির্যাতিতার উদ্দেশে। তাঁর সঙ্গে এমনকী তুলনা টানলেন খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডে ধৃত রাজিয়া এবং আলিমা’র। পুলিশকে লক্ষ করে বোমা ছোড়ার অভিযোগে নির্যাতিতাকে ধরা সত্ত্বেও খুনের চেষ্টার ধারা যুক্ত করার পক্ষেও সওয়াল করলেন ওই দুই আইনজীবী।

সিউড়ি জেলে গিয়ে নির্যাতিতার সঙ্গে দেখা করলেন জেলার বাম বিধায়কেরা।

তাতেও শেষরক্ষা হল না! তার প্রধান কারণ, পিপি এবং এপিপি-র সওয়ালকে সমর্থন করেনি খোদ পুলিশেরই আদালতে জমা দেওয়া কেস ডায়েরি! আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে এ দিন নির্যাতিতা এবং তাঁর শাশুড়ির জামিন মঞ্জুর করেন বীরভূমের মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়। জামিন অবশ্য শর্তসাপেক্ষ। সিজেএমের নির্দেশ, নতুন কোনও নির্দেশ আসা না পর্যন্ত দুই মহিলাকে সিজেএম আদালতের হেড ক্লার্কের কাছে প্রতি দিন হাজির দিতে হবে।

নির্যাতিতার পক্ষের আইনজীবী সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুলিশ এ দিনই কেস ডায়েরি জমা করেছে। বিচারক তা পড়ে দেখেছেন। দু’পক্ষের সওয়াল-জবাবও শুনেছেন। তার পরেই তিনি শর্ত সাপেক্ষে নির্যাতিতা ও তাঁর শাশুড়িকে জামিন দিয়েছেন।’’ দুই মহিলার জন্য ৫ হাজার টাকা বন্ড দিয়ে জামিনদার হয়েছেন আদালতের এক আইনজীবী ও ল’ক্লার্ক।’’ তবে, এ দিনও নির্যাতিতার স্বামী-সহ ধৃত বাকি চার জনের জামিন খারিজ হয়ে গিয়েছে।

সাত্তোরের নির্যাতিতার মুক্তির দাবিতে সিউড়িতে জেলা
পুলিশ সুপারের দফতরের সামনে চারটি বাম মহিলা সংগঠনের বিক্ষোভ।

আদালতের নির্দেশ পেয়ে এ দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ নির্যাতিতা ও তাঁর শাশুড়িকে সংশোধনাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে আসে চার বছরের ছেলেও। নির্যাতিতাকে দেখে জড়িয়ে ধরেন দুপুর থেকে আদালত চত্বরে হাজির থাকা বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। নির্যাতিতা বলেন, ‘‘এখন শাসকেরই দিন। যারা শাসক, তাদেরই কথা শোনা হয়। আমার উপর যারা অত্যাচার করল, তারা আজও গ্রেফতার হয়নি। অথচ আমাকে মিথ্যা অভিযোগে পাঁচ দিন জেল খাটতে হল।’’ রূপার সঙ্গে তাঁর গাড়িতেই সাত্তোরে নিজের বাড়ি ফেরেন নির্যাতিতা।

গত ৪ জুলাই, শনিবার তৃণমূলের সাত্তোর অঞ্চল অফিসে বেশ কিছু বোমা মেলে। বিকেল পর্যন্ত তা উদ্ধার করেনি পুলিশ। প্রতিবাদে বিকেলে সাত্তোর বাসস্টপ এলাকায় সিউড়ি-বোলপুর রাস্তা অবরোধ শুরু করেন বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরা। সেই দলে ছিলেন নির্যাতিতা ও তাঁর পরিবার। এর পরেই একাধিক জামিন-অযোগ্য ধারায় বিজেপি সমর্থক পরিবারের ওই বধূ, তাঁর স্বামী ও শাশুড়ি-সহ ছ’জনকে গ্রেফতার করে পাড়ুই থানার পুলিশ। ধৃতদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৩ (‌বেআইনি জমায়েত), ৩৫৩ (সরকারি কর্মীকে হেনস্থা), ১৮৬ (সরকারি কর্মীর কাজে বাধা), ৫০৬ (হুমকি) এবং বিস্ফোরক আইনের ৩/৪ (মারাত্মক বিস্ফোরণ ঘটানোর মতো বিস্ফোরক মজুত রাখা বা বিস্ফোরণ ঘটানো) ধারায় মামলা রুজু করে পুলিশ। এগুলির মধ্যে দু’টি ধারা (৩৫৩ ও ৩/৪) জামিন অযোগ্য। রবিবার সিউড়ি আদালত ধৃতদের জেল-হাজতের নির্দেশ দেয়। মঙ্গলবার বোলপুরে প্রশাসনিক বৈঠক করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে সমর্থন জানিয়ে নিশানা করেন সাত্তোরের নির্যাতিতাকেই!

তখনও জামিন মেলেনি। সিউড়ি আদালত চত্বরে গাড়িতে আদালতের
নির্দেশের অপেক্ষায় বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়।

এ দিন পৌনে ৩টে নাগাদ সাত্তোরের মামলাটি ওঠে। প্রথমেই সোমনাথবাবু আদালতকে জানান, এই মামলায় ধৃতদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনের ৩/৪ ধারা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগপত্রে নির্দিষ্ট করে কে বোমা ছুড়েছে, তা বলা হয়নি। সোমনাথবাবু প্রশ্ন তোলেন, ‘‘সাত্তোরে কি কোনও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চলছিল? না কি বিস্ফোরক তৈরির কারখানা?’’ এর পরেই তিনি বলেন, ‘‘স্যার, সিজার লিস্টটা দেখুন। একটি বোমা ও কিছু সুতো উদ্ধার হয়েছে। তাতে কি এই ধারা প্রযোজ্য হয়? স্রেফ ৩৫৩ ধারা কাউকে গরাদের পিছনে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। আমি যে কোনও শর্তে ছ’জনেরই জামিনের আবেদন রাখছি। যদি তা মঞ্জুর না হয়, অন্তত পক্ষে দুই মহিলাকে জামিন দিন।’’

পাল্টা বলতে উঠে এপিপি কুন্তল চট্টোপাধ্যায় বিচারককে বলেন, ‘‘তদন্ত এখন প্রাথমিক পর্যায়ে। যে কেস ডায়েরি পুলিশ আদালতে জমা দিয়েছে, তাতে আরও কিছু যোগ হওয়ার আছে। এই মুহূর্তে অভিযুক্তদের জামিন দিলে সাক্ষী-সাবুদ প্রভাবিত ও নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে।’’ পিপি রণজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওই দুই মহিলা অত্যন্ত ‘ডেঞ্জারাস’ ও প্রভাবশালী। ইতিমধ্যেই এই ঘটনায় দু’জন গোপন জবানবন্দিও দিয়েছে। তাঁদের এক জনকে ভয় দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ। জেলে থাকতেই এক মহিলা যদি এতটা প্রভাব খাটাতে পারেন, তিনি বাইরে বেরোলে এলাকা অশান্ত হবে। সাক্ষীদের ভয়ও দেখানো হবে।’’

পিপি বলেন, ‘তর্ক সাপেক্ষে ধরে নিলাম, ৩/৪ ধারা এখানে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু আমার তো মনে হয়, পুলিশের এখানে ৩০৭ ধারা যুক্ত করা উচিত ছিল!’’ এর পরেই খাগড়াগড় প্রসঙ্গ টেনে পিপি বলেন, ‘‘খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সময় আমরা দেখেছি, কী ভাবে বিস্ফোরক তৈরিতে মহিলারা সাহায্য করেছেন। শিশুকোলে নিয়ে গিয়েই ওই মহিলারা জেলে গিয়েছেন। তাই মহিলারা সব সময় নির্দোষ হবেন, এটা আমি মনে করি না।’’

পিপি-র বক্তব্যের তীব্র আপত্তি করে অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী বলেন, ‘‘মহিলা অত্যন্ত ডেঞ্জারাস এবং প্রভাবশালী, তার একটাও প্রমাণ দেখাতে পারবেন? এর আগে ওই দুই মহিলার বিরুদ্ধে কোথাও কোনও অভিযোগ দায়ের হয়েছে? একটি জেনারেল ডায়েরিও? তাঁরা বিপজ্জনক হলে পুলিশ নিজেদের হেফাজতে চাইল না কেন?’’

অভিযুক্ত পক্ষের আর এক আইনজীবী নির্মল মণ্ডল বিচারককে বলেন, ‘‘আপনার নিশ্চয় মনে আছে, ওই মহিলার উপর পুলিশ কেমন অত্যাচার চালিয়েছিল। আপনিই পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। সেই আক্রোশ থেকেই এই মহিলাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে শোধ তুলেছে পুলিশ!’’

দু’পক্ষের কথা শুনে বিচারকের পর্যবেক্ষণ, এই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের ৩/৪ ধারা প্রযোজ্য নয়। পো়টা-র (আগে যা টাডা ছিল) (প্রিভেনশন অফ টেরোরিজম অ্যাক্ট) ক্ষেত্রেই এই ধরনের ধারা দেওয়া যায়। আদালতের আরও পর্যবেক্ষণ, পুলিশের কেস ডায়েরিতে এমন কোনও তথ্য মেলেনি, যে যুক্তিতে ওই দুই মহিলার জামিন নামঞ্জুর করা যায়। পুলিশ ধৃতদের কখনও হেফাজতে চায়নি। এমনকী, এখনও পর্যন্ত ওই মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধে যুক্ত থাকার কোনও প্রমাণও পেশ করতে পারেনি পুলিশ। এর পরেই বিচারক ওই দু’জনের শতর্সাপেক্ষে জামিনের নির্দেশ দেন।

কেস ডায়েরির ভিত্তিতে দুই মহিলা জামিন পাওয়ার পরে প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। রাতে জেলা পুলিশের এক কর্তা কার্যত মেনে নেন, তাঁদের হাতে মুখ্যমন্ত্রীর কথা মতো তেমন ‘কিছু’ ছিল না! তিনি বলেন, ‘‘কারও হেফাজত থেকে বোমা উদ্ধার করা যায়নি। ফলে কেস ডায়েরিতে নির্দিষ্ট কারও নাম লেখা যায়নি। তা ছাড়া, ওই মহিলার জামিন আটকানোর মতো তথ্যপ্রমাণও আমরা জোগাড় করতে পারিনি!’’

পাশাপাশি দুই সরকারি আইনজীবীর ভূমিকা নিয়েও নিন্দার ঝড় উঠেছে বিরোধী শিবিরে। নির্যাতিতাকে নিয়ে সাত্তোরে ফেরার আগে বিজেপি নেত্রী রূপা বলেন, ‘‘ওরা অন্যায় ভাবে নির্যাতিতাকে আটকে রেখেছিল। পিপি অনেক অবাস্তব কথা বলেছেন শুনেছি। তার পরেও আদালত কিন্তু জামিন মঞ্জুর করেছে। বিচার ব্যবস্থার প্রতি পূর্ণ আস্থা রয়েছে আমাদের। ’’

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘আমি মনে করি, আজও বিচার-ব্যবস্থা সতেজ, সক্রিয় এবং‌ নিরপেক্ষ আছে বলে বাংলায় নির্যাতিত মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে। কোথাও এই পুলিশ তৃণমূলের মারের ভয়ে টেবিলের তলায় লুকোয়! আর সাত্তোরে তারাই বীরপুঙ্গব হয়ে সংখ্যালঘু পরিবারের বধূকে নির্যাতন করে!’’ নির্যাতিতার জামিনে মুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর তো কোনও শিক্ষা হবে না! কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন এবং সরকারি কৌঁসুলিদের উচিত এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর অন্যায় আবদারের কাছে মাথা নত না করা!’’

কী বলছেন পিপি এবং এপিপি?

রণজিৎবাবুর বক্তব্য, ‘‘এজলাসে যা বলেছি, আমি আমার বিশ্বাস থেকে বলেছি। এক জন সরকারি আইনজীবী হিসেবে যা কর্তব্য ছিল, তা পালন করেছি।’’ তবে, সওয়াল-জবাবের সময় না বললেও পরে ফোনে তিনি মেনেছেন, এই ঘটনায় পুলিশের ৩/৪ ধারা দেওয়া ঠিক হয়নি। এ ক্ষেত্রে ৩০৭ দেওয়া উচিত ছিল।

ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

public prosecutor sattor wife dangerous criminal suri court sattor bail plea sattor wife bail
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy