Advertisement
E-Paper

কান ধরে ওঠবোস করুক পুলিশ, নিদান দোলার

খাতায়-কলমে আইন যা-ই বলুক, সে সব অন্তত তাঁদের জন্য নয়। শাসকদলের নেতা-মন্ত্রী বা তাঁদের আত্মীয়-পরিজনের ক্ষেত্রে ইদানীং এটাই যে রাজ্যে দস্তুর হয়ে উঠেছে, শুক্রবার তা ফের প্রমাণ হল। এ বার তির তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ দোলা সেনের দিকে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৫ ০৩:২১
বিভাস রায় ও দোলা সেন

বিভাস রায় ও দোলা সেন

খাতায়-কলমে আইন যা-ই বলুক, সে সব অন্তত তাঁদের জন্য নয়।

শাসকদলের নেতা-মন্ত্রী বা তাঁদের আত্মীয়-পরিজনের ক্ষেত্রে ইদানীং এটাই যে রাজ্যে দস্তুর হয়ে উঠেছে, শুক্রবার তা ফের প্রমাণ হল। এ বার তির তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ দোলা সেনের দিকে। অভিযোগ, দোলাদেবীর গাড়ি ট্র্যাফিক-আইন ভাঙলে জনৈক গ্রিন পুলিশ বাধা দিয়েছিলেন, যাতে অগ্নিশর্মা হয়ে সাংসদ তাঁকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠ-বোস করাতে চান।

এ দিন সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ বাগুইআটির চিনার পার্কে ঘটনাটি ঘটেছে। ক’দিন আগে রাসবিহারীতে মেয়রের ভাইঝির হাতে ট্র্যাফিক পুলিশের হেনস্থার অভিযোগ ঘিরে ঝড় উঠেছিল। তার রেশ না কাটতেই দোলা-কাণ্ডের জেরে ফের শোরগোল পড়েছে। দোলাদেবী নিজে ও স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষ অভিযোগ বেমালুম অস্বীকার করলেও প্রত্যক্ষর্শীদের অনেকের বয়ানে অভিযোগেরই সমর্থন। রাজপথের পুলিশকে বারবার হেনস্থার এ হেন পরম্পরা যে বাহিনীর মনোবল ক্রমশ ভেঙে দিচ্ছে, প্রশাসনের অনেকেও ঠারেঠোরে তা স্বীকার করছেন।

বাস্তবিকই পর পর কয়েকটি ঘটনায় দেখা গিয়েছে, নেতা-নেত্রীদের ট্র্যাফিক-বিধি মানানোর শিক্ষা দিতে গিয়ে পুলিশকেই উল্টে হেনস্থা হতে হয়েছে। কখনও বা নেতার নামে নামমাত্র অভিযোগ লেখা হয়েছে। অথচ জেরার চোটে জেরবার হতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট পুলিশকর্মীকে। কিছু ক্ষেত্রে নিচুতলার প্রতিবাদী পুলিশকর্মী হয়ে গিয়েছেন উপরতলার বিরাগভাজন!

এবং দোলা-কাণ্ডেও সেই ট্র্যাডিশন অব্যাহত। পুলিশ-সূত্রের খবর: বাগুইআটি ট্র্যাফিক গার্ডের অধীনে কর্তব্যরত ওই গ্রিন পুলিশ বিভাস রায়ও এ দিন উঁচুতলার ধমক খেয়েছেন। পুলিশের একাংশের দাবি, দোলার তেতে ওঠা মেজাজ দেখে ট্র্যাফিক গার্ডের গুমটি থেকে চলে আসা কয়েক জন অফিসারও বিভাসবাবুকে বকাবকি করেন। ওই তল্লাটেরই বাসিন্দা এক জন এমপি’কে না-চেনাটা যে পুলিশকর্মীর পক্ষে অপরাধ, সে কথাও ওঁরা বিভাসবাবুকে স্মরণ করিয়ে দেন। ‘‘শুনে
আমরা অবাক হয়ে যাই।’’— বলছেন এক প্রত্যক্ষদর্শী।

বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিভাসবাবু ‘কৃতকর্মের’ জন্য দুঃখপ্রকাশ করলেও দোলাদেবীর মন গলেনি। বরং উপস্থিত লোকজনকে স্তম্ভিত করে তিনি জেদ ধরেন, সকলের সামনে বিভাসবাবুকে কান ধরে ওঠ-বোস করতে হবে।

তখন প্রমাদ গোনেন ট্র্যাফিক গার্ডের অফিসারেরা। সাংসদকে তাঁরা বোঝান, উর্দি-পরা আইনরক্ষককে এমন শাস্তি দিলে পুলিশের মানসম্মান ধুলোয় লুটোবে। শুনে দোলা কিছুটা শান্ত হলেও শাসানি বন্ধ করেননি। অভিযোগ, ওই তরুণ গ্রিন পুলিশকর্মীর নাম-ঠিকানা ইত্যাদি টুকে নিয়ে ড্রাইভারকে তিনি গাড়ি ছাড়তে বলেন।

এ প্রসঙ্গে রাজ্য প্রশাসন বা শাসকদলের তরফে এখনও কেউ মন্তব্য করেননি। বিধাননগর কমিশনারেটের ডিসি (ট্র্যাফিক) শিবানী তিওয়ারির মন্তব্য, ‘‘আমাদের কাছে কোনও অভিযোগ নেই। কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ ক’দিন আগে রানিগঞ্জে থানায় বোমা মারার হুমকি দেন সৌমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামে যে তৃণমূল ছাত্রনেতা, এ দিনই তিনি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি আইনজীবী দাঁড় করায়নি পুলিশ।

দোলা অবশ্য আগেও এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ। রাজপথে তাঁর একই রকম অগ্নিমূর্তি দেখা গিয়েছিল বছর তিনেক আগে, নিবেদিতা সেতুতে। মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে ডেকরেটর্সের মালপত্র বোঝাই লরি নিয়ে ব্রিজে উঠতে গিয়ে তিনি সে দিন টোল প্লাজার কর্মীদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পুলিশের দাবি, সে যাত্রাও প্লাজা-কর্মীকে চড় মেরে ডাঁটের সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিলেন দোলা। সে বারও প্রশাসন কার্যত হাত গুটিয়ে বসে ছিল। নিগৃহীত প্লাজা-কর্মী সুবিচার পাননি।

ঠিক যেমন এ দিন কর্তব্য পালন করতে গিয়ে অপমানিত বিভাসবাবুই মুখ লুকিয়ে চলে গিয়েছেন। পরে তিনি এ ব্যাপারে আর মুখ খুলতে চাননি। ‘‘এমপি’র সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল।’’— ফোনে ধরা হলে শুধু এটুকু বলেই রেখে দিয়েছেন।

ঠিক কী ঘটেছিল?

প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশের সূত্রে জানা যাচ্ছে, চিনার পার্কে দোলার গাড়ি রাস্তার ডিভাইডার টপকে ‘রং রুটে’ ঢুকে পড়েছিল। বেশ ক’টি গাড়িকে ওভারটেক করে একটা গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে বিভাসবাবু গাড়িটি থামান। দোলাদেবীর গাড়ির চালক প্রথমে বিভাসের কাছে জানতে চান, তিনি কি জানেন, কার গাড়ি আটকেছেন? বিভাস জবাব দেন, ‘যাঁরই হোক, সবাইকে আইন মেনে চলতে হবে।’

আর তা শুনেই ফুঁসে ওঠেন দোলাদেবী। অভিযোগ, বিধাননগর কমিশনারেটের এক পদস্থ আধিকারিককে ফোন করে তিনি জানান, ওই গ্রিন পুলিশ তাঁর সঙ্গে ‘খারাপ ব্যবহার’ করছেন। দোলাদেবীর গাড়িকে চিনতে পেরে ততক্ষণে সেখানে চলে এসেছেন বাগুইআটি ট্র্যাফিক গার্ডের লোকজন। তাঁরাই এমপি’কে শান্ত করেন।

ঠিক কী ঘটেছিল, জানতে দোলাদেবীকেও ফোন করা হয়েছিল। উনি প্রথমেই বলেন, ‘‘আপনারা কি চিনার পার্কের কোনও ঘটনা জানতে চাইছেন?’’ জবাবও দেন নিজেই—‘‘না, না, ওখানে আমার সঙ্গে কিছুই ঘটেনি।’’ গ্রিন পুলিশের সঙ্গে বিতণ্ডা বা কান ধরে ওঠ-বোস করাতে চাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলেও সাংসদ বারবার বলতে থাকেন, ‘‘ওখানে কিছুই ঘটেনি, কিছুই ঘটেনি।’’ বলতে থাকতে এক সময়ে নিজেই ফোন রেখে দেন।

বিরোধী শিবির স্বভাবতই সরব। সিপিএমের বিমান বসু এ দিন মালদহে বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী আইন ভাঙায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর দেখানো পথেই দোলা আইন ভেঙেছেন। সুশিক্ষা থাকলে এমন করতেন না।’’ বাগুইআটির এক সভায় সিপিএম নেতা গৌতম দেবের কটাত্ক্ষ, ‘‘দোলা সেন যা মেটেরিয়াল, তার ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। ওঁর ডিএনএ এবং পেডিগ্রি, দু’টোই দেখতে হবে।’’

অন্য দিকে বিভাসের পরিচিত মহলে উদ্বেগের আবহ। বাগুইআটি থানা-এলাকার অর্জুনপুরের চড়কতলায় বিভাসের বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পাড়ার ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে আত্মীয়-পড়শিরা চিন্তিত। তাঁদের ধারণা, এমপি’র গাড়ি আটকানোর মাসুল হিসেবে ওর চাকরিতে অসুবিধে হতে পারে।

সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত মাথায় রেখে পুলিশমহলের নিচুতলা ওঁদের আশঙ্কাকে অমূলক বলে উড়িয়েও দিতে পারছে না। অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, মেয়রের ভাইঝির বিধি-ভাঙা গাড়ি আটকেছিলেন যে ট্র্যাফিক কনস্টেবল, তাঁকেই হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছিল। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও ওই ঘটনায় ট্র্যাফিক কনস্টেবলের দিকেই আঙুল তুলেছিলেন!

‘‘এমতাবস্থায় শাসকের রক্তচক্ষু দেখলে ঘরপোড়া পুলিশ ভয় না পেয়ে কী করবে?’’— আক্ষেপ এক পুলিশ অফিসারেরই।

abpnewsletters Trinamool Trinamool MP Traffic Rajya Sabha Dola Sen
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy