‘মেয়েলি ছেলে’ বা ‘পুরুষালি মেয়ে’ তকমায় গেঁথে বাড়িতে বা স্কুলে রীতিমতো কোণঠাসা হয় তারা। স্কুলে শৌচাগারে যাওয়া বা ডাক্তার দেখানো, হাসপাতালে যাওয়াও আতঙ্ক সেই সব কিশোর বয়সিদের জন্য। রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের উদ্যোগে একটি সমীক্ষায় প্রকাশ, পাঁচটি জেলায় ১৫০০ জন অপ্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশেরই এই দশা। এই ধরনের ছোটরা অনেকেই গভীর অবসাদের শিকার এবং আত্মহত্যাপ্রবণ বলে সাবধান করছেন মনোরোগ চিকিৎসকেরা।
কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া এবং মুর্শিদাবাদে ১৪-১৮ বছর বয়সি ১৫০০ জনের মধ্যে একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ২৯৬ জনই নিজেদের ছকে-বাঁধা ছেলে বা মেয়ে পরিচয়ে চিহ্নিত করতে চায় না। কমিশনের চেয়ারপার্সন সুদেষ্ণা রায়ের কথায়, “তথাকথিত ছকে-বাঁধা ছেলে বা মেয়েসুলভ নয় বলে ছোটরা অনেকেই বাড়িতে নির্যাতনের শিকার বলে আমরা খবর পাচ্ছিলাম। সবার জন্য স্কুলও নিরাপদ পরিসর নয় বলেই মালুম হচ্ছিল। এই সমস্যার গভীরতা বুঝতেই সমীক্ষা চালানো জরুরি ছিল।” কমিশনের উপদেষ্টা অনন্যা চক্রবর্তীর মতেও, গোটা দেশে অভূতপূর্ব এমন সমীক্ষায় অভিভাবক, শিক্ষকদের নানা ভুল ধারণা ভাঙবে। তিনি জানাচ্ছেন, এই সমীক্ষার ভিত্তিতে রাজ্যে ছেলে, মেয়েদের বাইরে ছক-ভাঙা বা রূপান্তরকামী ছোটদের জন্যও আলাদা বা নিরাপদ হোমের সুপারিশ করা হয়েছে। তা ছাড়া, স্কুল পাঠ্যক্রমেও রূপান্তরকামী তথা ছেলে, মেয়ের বাইরে যৌন সংখ্যালঘুদের বিষয়ে সচেতন করার আর্জি জানানো হয়েছে।
ছক-ভাঙা মেয়ে, পুরুষ বা রূপান্তরকামীদের নিয়ে ইদানীং রাজ্যে সচেতনতা বাড়লেও মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়ের মতে, “এখনও অনেকেই সন্তান অন্য রকম হওয়াটা অসুখ ভাবেন। কিংবা কেন আমার পরিবারেই এমন ঘটল বলে হাহুতাশ করেন। তাতে ছোটরাও অবসাদে ভোগে। আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়।” রিমার মতে, “শরীরে ছেলে বা মেয়ে হলেই ছোটরাও অনেকে মনেপ্রাণে পুরুষ বা নারী হয়ে উঠতে চান না। এটাই স্বাভাবিক। এটা বড়দের বুঝতে হবে।”
কমিশনের উদ্যোগে এই ‘রেনবো সমীক্ষাটি’ যাঁরা চালিয়েছেন তাঁদের তরফে বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়ও বলছেন, “সারা দুনিয়ায় যে কোনও জন গোষ্ঠীর নমুনাতেই ১৫-২০ শতাংশ ছকে-বাঁধা নারী, পুরুষ পরিচয়ের বাইরে বলে দেখা যায়।” এ রাজ্যের সমীক্ষাটিতে দেখা যাচ্ছে, রূপান্তরকামী পরিচয়ে স্বচ্ছন্দ ছোটদের ৭৩.৬ শতাংশ বাড়িতে নিরাপদ বোধ করে না। ৬২.৫ শতাংশ স্কুলে অস্বস্তিতে ভোগে। আবার ৬৬.৯ শতাংশের ক্ষেত্রে স্কুলে মানসিক আশ্রয় কোনও বন্ধু বা শিক্ষক আছেন। তবে কারও স্কুলছুট হওয়ার সঙ্গে লিঙ্গ পরিচয়ের সরাসরি যোগ মেলেনি। কমিশনের উদ্যোগে রাজ্যের বিভিন্ন স্কুল, মাদ্রাসায় সচেতনতার কর্মসূচি শুরু হয়েছে। হিজড়েদের অধিকার নিয়ে সক্রিয় সমাজকর্মী অপর্ণা, রূপান্তরকামী পুরুষ তথা সরকারি ট্রান্সজেন্ডার ডেভলপমেন্ট বোর্ডের সদস্য ক্ষৌণীশ, রূপান্তরকামী পুরুষ আইনজীবী অঙ্কন প্রমুখ তাঁদের অভিজ্ঞতা শুনিয়ে সচেতন করছেন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)