প্রতি বছর লাফিয়ে বাড়ছে পুজোর অনুদান। অথচ টাকার অভাবে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ছে জেলায় ট্রমা কেয়ার সেন্টারের উদ্যোগ। অমিল হচ্ছে জীবনদায়ী ওষুধ। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামো এমনই সঙ্গিন যে, রোগী সেখানে পৌঁছতেই পারছেন না।
বৃহস্পতিবার পুজো-প্রতি এক লক্ষ ১০ হাজার টাকা অনুদান ঘোষণা হওয়ার পরে এমনই চাপা ক্ষোভ শোনা যাচ্ছে চিকিৎসক মহলে। যদিও স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশের যুক্তি, কেন্দ্রীয় অনুদান সময় মতো না পাওয়ার কারণেই আটকে থাকছে স্বাস্থ্যের বহু প্রকল্প। পাল্টা হিসেবে চিকিৎসক শিবিরের একাংশের দাবি, কেন্দ্রের থেকে সময়মতো টাকা না পাওয়ার পরেও অনেক প্রকল্পই রাজ্য নিজস্ব কোষাগার থেকে চালিয়ে নিচ্ছে। তা হলে যে পরিষেবার সঙ্গে মানুষের জীবন জড়িত, সেই স্বাস্থ্যক্ষেত্র কেন শুধু কেন্দ্রের উপর নির্ভরকরে থাকবে?
সুপ্রিম কোর্টের পথ নিরাপত্তা সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশ মেনে বছর দুয়েক আগে রাজ্যের ১৪টি জেলায় ১৫টি ট্রমা কেয়ার সেন্টার তৈরির নির্দেশিকা জারি করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। পশ্চিম বর্ধমান, হাওড়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম, পুরুলিয়া, নদিয়া, ঝাড়গ্রাম, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, বাঁকুড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর দিনাজপুরে ‘লেভেল থ্রি ট্রমা কেয়ার সেন্টার’ গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। অভিযোগ, হাতে গোনা কয়েকটি জেলায় সেই পরিষেবা চালু হলেও পরিকাঠামোর অভাবে সেগুলি খুঁড়িয়ে চলছে। আর বাকি জায়গায় আপাতত গোটা পরিকল্পনাই বিশ বাঁও জলে। অথচ পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার কমাতে এই ট্রমা সেন্টারগুলির ভূমিকা হতে পারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কর্তাদের বক্তব্য, ‘‘কী করব?হাত ফাঁকা!’’
আবার, দীর্ঘ সময় ধরে কেমোথেরাপি, ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ, স্ট্রোকের ইঞ্জেকশন, জলাতঙ্কের প্রতিষেধক, হিমোফিলিয়ার ইঞ্জেকশনের (ফ্যাক্টর-৭, ৮) ভাঁড়ার কার্যত খালি। সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে শুরু করে মেডিক্যাল কলেজ— সর্বত্র এক দশা। যদিও স্বাস্থ্যকর্তাদের দাবি, জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের টাকা না পাওয়ার জন্য ওই সব ওষুধ কেনায় সমস্যা হচ্ছে। স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরের খবর, কোনও কোনও ক্ষেত্রে রাজ্য নিজস্ব তহবিল থেকে ওষুধ কেনার কথা বললেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় নেহাতই অপ্রতুল। খোদ চিকিৎসকদেরই প্রশ্ন, যত টাকা পুজোর অনুদান দেওয়া হচ্ছে, তার কিছুটা অংশও কি অতি প্রয়োজনীয় ওই সব ওষুধের জন্য খরচ করা যায় না?
কোথাও আবার নতুন আর্থোস্কোপি, ল্যাপারোস্কোপি যন্ত্রের জন্য বার বার আবেদন করেও তা মিলছে না। ফলে অস্ত্রোপচারের সংখ্যা কমছে। বাড়ছে অপেক্ষায় থাকা রোগীর ভিড়। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির এমনই বেহাল দশা, জল দমে থাকে, রাস্তা ভাঙা, প্রসূতিরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছতেই পারছেন না। সমস্ত মেডিক্যাল কলেজে এইচআইভি পজ়িটিভদের জন্য ‘অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি’ (এআরটি) সেন্টার থাকলেও লোকবলের অভাবে সেগুলি কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। রক্তদান শিবির থেকে আসা রক্তের ‘নিউক্লিক অ্যাসিড টেস্ট’ (ন্যাট)-এর ব্যবস্থার জন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ হবে বলে জানা গিয়েছিল। যদিও সেটি আজও কার্যকর হয়নি স্রেফ এত টাকা খরচের কথা ভেবেই। এর ফলে রক্ত নিরাপত্তার সঙ্গে আপস চলছে প্রতি পদেই।
অন্য দিকে, তহবিল না থাকায় ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও স্বাস্থ্য দফতরের ২০০টি অ্যাম্বুল্যান্স বদল করা যায়নি। কাজ চলছে লজঝড়ে গাড়িতেই। এখানেই শেষ নয়। স্বাস্থ্য ভবনের অন্দরের খবর, প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়ুয়াদের ‘স্কিল-ল্যাব’ তৈরির জন্য ২০২২ সালে কমিটি গঠন হয়েছিল। প্রতিটি কলেজকে প্রায় দু’কোটি টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও, তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। প্রাক্তন এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, “স্কিল-ল্যাব তৈরির বিষয়ে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের স্পষ্ট নির্দেশিকা আছে। কিন্তু রাজ্যের তো টাকাই নেই! তাই ধাক্কা খাচ্ছে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)