Advertisement
E-Paper

সন্দেশখালির ‘মাথা’ ঠান্ডা করতে দিনভর ঘুরলেন দুই মন্ত্রী, ধৈর্য হারালেন শেষ বেলায়, ‘সামলেও’ নিলেন

শাহজাহানের গ্রেফতারি নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই মেজাজ হারান মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক। বলেন, “নিশ্চয়ই এই কথাটা কেউ শিখিয়ে দিয়েছে।” তাঁর এই মন্তব্যে ক্ষোভ জানান অভিযোগ জানাতে আসা মহিলারা।

সারমিন বেগম

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২১:৫৯
Two TMC ministers visited Sandeshkhali to address the public grievances on Saturday

গ্রামবাসীদের অভিযোগ শুনছেন দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু এবং সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

কারও অভিযোগ, চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে! কারও আবার রাস্তাঘাট ভাল নয়, সব ভেঙে পড়ে আছে, বলে অভিযোগ। শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা— সন্দেশখালিবাসীর এই সব অভাব-অভিযোগ শুনলেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী সুজিত বসু এবং পার্থ ভৌমিক। আশ্বাসও দিলেন, সব আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

শনিবার সকালে দুই মন্ত্রী প্রথমে ধামাখালিতে যান। সেখান থেকে কালিন্দী নদী পেরিয়ে যান সন্দেশখালি। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় বিধায়ক সুকুমার মাহাতো এবং স্থানীয় ‘মাস্টারমশাই’ সুজয় মণ্ডল। টোটো নিয়ে পাত্রপাড়া হয়ে কাছারিপাড়ায় যান সুজিতেরা। সেখানে পা রাখতেই মন্ত্রী-বিধায়কদের ঘিরে ধরে কোন পরিস্থিতিতে, কী ভাবে দিন কাটাচ্ছেন, তা নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন স্থানীয়েরা। মন্ত্রী-বিধায়কদের দেখে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কেউ কেউ আবার ক্ষোভ উগরে দেন। অভিযোগ মূলত ‘নিখোঁজ’ তৃণমূল নেতা শাহজাহান শেখের শাগরেদ শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারদের বিরুদ্ধে। কাছারিপাড়ায় সুজিত-পার্থেরা যেতেই তাঁদের কাছে অভিযোগ আসে যে, রাস্তাঘাট ভাল নয়। সারাইয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। পানীয় জলেরও খুব সমস্যা। এ ছাড়াও চাষের জমি দখল করে ভেড়ি বানানোর মতো অভিযোগও জানানো হয়। মন্ত্রীরা আশ্বাস দেন যে, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। তার জন্য তাঁরা সময়ও চেয়ে নেন গ্রামবাসীদের কাছ থেকে। মন্ত্রী সুজিত বলেন, “চাষের জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। যে সব জমিতে জল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলিকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে ঠিক করে। সেচ দফতর সেই ব্যবস্থা করবে। ২০ দিনের মধ্যেই হয়ে যাবে।”

সন্দেশখালি, জেলিয়াখালির পর ঝুপখালিতেও শনিবার উত্তেজনাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেখানে গ্রামবাসীদের নিশানায় ছিলেন শাহজাহানের ভাই সিরাজুদ্দিন শেখ ওরফে সিরাজ। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, তাঁদের জমি দখল করে নিয়েছেন ওই ব্যক্তি। কারও অভিযোগ, তাঁর দোকান পর্যন্ত সিরাজের জিম্মায়। এ ভাবে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ বিঘা জমি দখল করে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। সিরাজের বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ ওঠার পরেই বিধায়ক সুকুমার দাবি করেন, ‘অনেক আগে’ পঞ্চায়েতের অঞ্চল সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সিরাজকে। মন্ত্রী পার্থও বলেন, ‘‘অনেক আগেই (সরানো) হয়েছে। সুকুমার বলেনি?’’ তবে সেই ‘আগে’ ঠিক কখন, তা নির্দিষ্ট করে জানাননি কেউই। পার্থ জানান, সিরাজের জায়গায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অজিত মাইতিকে। প্রশ্ন ওঠে, সেই অজিতকেও তো নানা অভিযোগে মারধর করেছেন গ্রামবাসীদের একাংশ! এ নিয়ে পার্থের জবাব, ‘‘অশান্তি করছে সিপিএম এবং বিজেপি। যেই জমি জখল করে নিন কেন, ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব মমতা সরকারের।’’

সন্দেশখালির ক্ষোভ প্রশমনে ঠান্ডা মাথাতেই একের পর এক অভিযোগ শুনছিলেন সুজিত-পার্থেরা। সমস্যা সমাধানের আশ্বাসও দিচ্ছিলেন। শেষ বেলায় এসে অবশ্য ধৈর্যচ্যুতি হয় তাঁদের। ধৈর্য হারালেও সামলে নেন। দলীয় কর্মীদের সঙ্গে কথা বলার পরে যখন পার্থ এবং সুজিত বেরোচ্ছিলেন, সেই সময় তাঁরা খবর পান যে, বিডিও অফিসের উল্টো দিকে কিছু মহিলা তাঁদের সঙ্গে কথা বলার জন্য বসে আছেন। মুখ ঢেকে থাকা ওই মহিলারা ‘নির্যাতনের’ অভিযোগ জানাতে থাকেন সেচমন্ত্রী এবং দমকলমন্ত্রীর কাছে। এই সময় এক মহিলা প্রশ্ন করেন, শাহজাহানকে কবে গ্রেফতার করা হবে? প্রশ্ন শুনেই পার্থ বলেন, “আপনাকে নিশ্চয়ই এই কথাটা কেউ শিখিয়ে দিয়েছেন!” কেন শাহজাহানের গ্রেফতারি নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের কিছু করণীয় নেই, তারও ব্যাখ্যা দেন তিনি। তবে মন্ত্রীর ‘শিখিয়ে দিয়েছেন’ মন্তব্য ক্ষুব্ধ মহিলারা হইচই শুরু করে দেন। শেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন আর এক মন্ত্রী সুজিত।

মন্ত্রীদের সঙ্গে সুজয় মাস্টার

শাহজাহান শেখ, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারদের বিরুদ্ধে সন্দেশখালিতে যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল, তাঁর অন্যতম মুখ ছিলেন তিনি। তৃণমূলের সদস্য হয়েও নেতৃত্বের একাংশের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। পরে গ্রেফতারও হন ‘মাস্টারমশাই’, পেশায় রাজ্য সরকারি স্কুলের পার্শ্বশিক্ষক সুজয় মণ্ডল। সেই তিনিই শনিবার রাজ্যের দুই মন্ত্রীর সঙ্গে ঘুরলেন সন্দেশখালিতে। আশাপ্রকাশ করলেন, ‘‘নেতৃত্ব যখন কথা দিয়েছেন, তখন কথা রাখবেন।’’ সেই প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি।

পদ থেকে অপসারিত সিরাজ

শাহজাহানের ভাই সিরাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগে মুখর সন্দেশখালিবাসীর বড় অংশ। এলাকায় ‘সিরাজ ডাক্তার’ নামে পরিচিত ওই তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে পুলিশের শিবিরে গিয়েও অভিযোগ জানানো হয়েছে। তবে সেই সিরাজ তৃণমূলের কোনও পদে নেই বলে দাবি করেছেন মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক। তাতে সায় দেন রাজ্যের আর এক মন্ত্রী সুজিতও।

অভিযোগের পাহাড়

শাহজাহান এবং তাঁর ভাই সিরাজউদ্দিনের ‘সৌজন্যে’ ধীরে ধীরে বদলে গিয়েছে এলাকার জমির ‘চরিত্র’। এমনই অভিযোগ বাসিন্দাদের একাংশের। তাঁদের আরও অভিযোগ, একের পর এক ফসলের ক্ষেত গায়ের জোরে দখল করে বানানো হয়েছে মাছের ভেড়ি। পাশাপাশি, জোর করে রায়ত (কৃষি) জমি দখল করে অনুগতদের নামে লিখিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে শাহজাহান-সিরাজের বাহিনীর দাপটে চাষের জমি ছাড়তে বাধ্য হওয়া গ্রামবাসীদের অনেকেই এ বার প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করছেন।

ছদ্মবেশে সন্দেশখালিতে মিনাক্ষী

পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে শনিবার সন্দেশখালিতে পৌঁছন মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়-সহ সিপিএমের যুব নেতা-নেত্রীরা। যান সিপিএম নেতারাও। গ্রামে গ্রামে ঘোরেন। কথা বলেন। গ্রেফতার-হওয়া প্রাক্তন বাম বিধায়ক নিরাপদ সর্দারের বাড়িতেও যান তাঁরা। শাড়ির সঙ্গে মাথায় হিজাব পরে রীতিমতো ‘ছদ্মবেশে’ সন্দেশখালি যান মিনাক্ষী। দুপুর দেড়টার পর যখন মিনাক্ষীদের পুলিশ আটকায়, তত ক্ষণে বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ফেলেছেন মিনাক্ষীরা। তত ক্ষণে উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও সফল হয়ে গিয়েছে তাঁদের।

শাহজাহান নিয়ে দুই মন্ত্রী

শাহজাহানের গ্রেফতারি নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই মেজাজ হারান মন্ত্রী পার্থ। তিনি বলেন, “আপনাকে নিশ্চয়ই এই কথাটা কেউ শিখিয়ে দিয়েছেন!” শাহজাহানের গ্রেফতারি নিয়ে তিনি বলেন, “শাহজাহানের গ্রেফতারির বিষয়টা আমাদের হাতে নেই। কলকাতা হাই কোর্ট বলেছে রাজ্য পুলিশ শাহজাহানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি শাহজাহানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।” কিন্তু মন্ত্রীর কথা শেষ হওয়ার আগেই তাঁর ‘শিখিয়ে দিয়েছেন’ মন্তব্য নিয়ে ক্ষোভ জানাতে থাকেন মহিলারা। কেন ওই ধরনের মন্তব্য করা হল, তা জানতে চান তাঁরা। শেষে পরিস্থিতি সামলাতে উদ্যোগী হন আর এক মন্ত্রী সুজিত। তিনি বলেন, “আমরা সব শুনলাম, দেখলাম।” এক মহিলা জানতে চান, তাঁরা সব কথা মুখ্যমন্ত্রীকে জানাবেন তো? মন্ত্রী আশ্বাসের সুরে জানান, তিনি সব কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানাবেন।

তবে শাহজাহানের গ্রেফতারি নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি সুজিত। সংবাদমাধ্যমের তরফে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, শাহজাহানের কী হবে? প্রায় এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতেই সুজিত বলেন, “বলতে পারব না।” পার্থ জানান, গ্রামবাসীরা শাহজাহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, তেমন কিছু তিনি শোনেননি। যা অভিযোগ করা হয়েছে, সবই শিবু-উত্তমদের বিরুদ্ধে। সন্দেশখালির আন্দোলন প্রসঙ্গে পার্থের দাবি, ‘‘কিছু লোক অন্যায় করেছে।’’ তার পরই তিনি বলেন, ‘‘ওরা (গ্রামবাসীরা) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিতে যাতে কেউ কালি লাগাতে না পারে, তার জন্য রাস্তায় নেমেছিল, ওরা তৃণমূলের শুদ্ধিকরণের জন্য রাস্তায় নেমেছিল।’’

Sujit Bose Partha Bhowmik TMC sandeshkhali
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy