Advertisement
E-Paper

আমেরিকা যেতে চাওয়াই কি কাল হল আকাঙ্ক্ষার?

কেন খুন হতে হয়েছিল বাঁকুড়ার আকাঙ্ক্ষা শর্মাকে—মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার দিনভর উদয়ন দাসকে জেরা করে দু’টি সম্ভাবনায় গুরুত্ব দিচ্ছে বাঁকুড়া পুলিশ। তার একটি— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাকরিস্থলে কবে সে আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ে যাবে, লাগাতার এই প্রশ্নের মুখে অস্বস্তিতে পড়েছিল উদয়ন।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৩৫
আকাঙ্ক্ষা শর্মা

আকাঙ্ক্ষা শর্মা

কেন খুন হতে হয়েছিল বাঁকুড়ার আকাঙ্ক্ষা শর্মাকে—মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার দিনভর উদয়ন দাসকে জেরা করে দু’টি সম্ভাবনায় গুরুত্ব দিচ্ছে বাঁকুড়া পুলিশ। তার একটি— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাকরিস্থলে কবে সে আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ে যাবে, লাগাতার এই প্রশ্নের মুখে অস্বস্তিতে পড়েছিল উদয়ন। দ্বিতীয় সম্ভাবনা— উদয়নের জীবনে আকাঙ্ক্ষা ছাড়াও একাধিক বান্ধবীর অস্তিত্ব, যাদের এক জন ভোপালের সাকেতনগরেরই বাসিন্দা বলে জেরায় পুলিশ জেনেছে। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হিরা বলেন, ‘‘তদন্ত একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ঠিক কী কারণে এই খুন এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।’’

পুলিশ সূত্রের দাবি, ২০০৮ সালে ‘সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট’ ‘অর্কুট’-এ আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আলাপ হয় ১৯৮৪ সালের ২৪ এপ্রিল জন্মানো উদয়নের। একটু-একটু করে বাড়ে ঘনিষ্ঠতা। মুখোমুখি দেখা হয় ২০১৪ সালে দিল্লিতে। গত বছর ২৩ জুন বাঁকুড়ার বাড়ি ছেড়ে দিল্লিতে গিয়েই উদয়নের সঙ্গে দেখা করেন আকাঙ্ক্ষা। সেখানে এক দিন কাটিয়ে, ২৫ জুন দু’জনে পৌঁছন ভোপালে। পুলিশের অনুমান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ইউনিসেফ’-এ যে চাকরি পাওয়ার কথা আকাঙ্ক্ষা বাড়িতে বলেছিলেন, তার নকল ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার’ উদয়নেরই বানানো। কিন্তু খুন হওয়ার আগে পর্যন্ত আকাঙ্ক্ষা জানতেন না, তিনি ‘ইউনিসেফ’-এ চাকরি পাননি। উদয়ন তাঁকে ভাঁওতা দিয়েছে।

জেরায় হাজির থাকা এক পুলিশ অফিসার জানান, উদয়ন তাঁদের জানিয়েছে, ১৫ জুলাই সকালে আকাঙ্ক্ষার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া নিয়ে দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। সেই সময়ে উদয়ন আকাঙ্ক্ষার গলা টিপে শ্বাসরোধ করে। খুনের পরে, তাঁর দেহ টিনের বাক্সে ভরে তার উপরে সিমেন্টের বেদি গড়ে। তবে বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার বলছেন, ‘‘খুনের দিনটা নিয়েও ধন্দ আছে। উদয়ন সত্যি বলছে কি না, আগে নিশ্চিত হই।’’

মঙ্গলবার প্রায় ছ’ঘণ্টা এবং বুধবার বিকেলের পরে উদয়নকে পুলিশ সুপারের দফতরে নিয়ে গিয়ে টানা জেরা করেছে পুলিশ। সেই সূত্রেই সামনে আসছে নতুন তথ্য। যেমন—উদয়ন দাবি করেছে, ছেলেবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে গায়ের রং নিয়ে নানা সময়ে উপহাসের মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। সমবয়সীরা তাকে ‘কালা-কালুটা বেঙ্গন লুটা’ (‘মিশকালো বেগুন চোর’) বলে খেপাত। সে জন্য ছোট থেকেই এলাকার সমবয়সীদের এড়িয়ে চলত সে। সেই সময় থেকেই তার মধ্যে জেদ চাপে জীবনে কেউকেটা হয়ে, এক সময়ের উপহাসকারীদের দেখিয়ে দিতে হবে। এক পুলিশ কর্তার কথায়, ‘‘প্রাথমিক ভাবে আমাদের ধারণা, সে সময় থেকেই উদয়ন যেন-তেন প্রকারেণ বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখত। বড়লোক হতে গেলে টাকার দরকার।

টাকা জোগাড়ের জন্য অপরাধের রাস্তায় হাঁটতে, এমনকী, নিজের বাবা-মা-কে খুনের রাস্তা বেছে নিতেও ও পিছ-পা হয়নি।’’

পুলিশকে উদয়ন জানিয়েছে, কিশোর বয়সেই সে অপরাধের পথ ধরেছিল। ‘অর্কুট অ্যাকাউন্ট’ হ্যাক করে দুই সহপাঠীর ‘প্রোফাইল’-এ অশ্লীল ছবি ও মন্তব্য ‘পোস্ট’ করে তাদের বেকায়দায় ফেলেছিল সে। তদন্তকারীদের দাবি, নেট-দুনিয়ায় উদয়ন অন্তত ১০০টি জাল ‘অ্যাকাউন্ট’ তৈরি করেছিল বা ব্যবহার করত। সাকেতনগরের বাড়ি থেকে উদয়নের সংগ্রহে থাকা প্রায় আড়াই হাজার ইংরেজি সিনেমার সিডি-ডিভিডি আটক করেছে পুলিশ, যার বেশিরভাগই অপরাধ জগতের নানা ঘটনার উপরে নির্মিত। উদয়ন অপরাধ সংক্রান্ত দেশি-বিদেশি অন্তত গোটা সাতেক টিভি সিরিয়াল দেখত বলেও জানিয়েছে তদন্তকারীদের। জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, মার্কিন দু’টি টিভি সিরিয়াল (ক্রাইম সিন ইনভেস্টিগেশন, ওয়াকিং ডেড) দেখে আকাঙ্ক্ষাকে খুনের ছক, দেহ লুকনোর কৌশল এবং খুনের পরে কী ভাবে স্বাভাবিক জীবন কাটাতে হয়— তা তার মাথায় এসেছিল বলে কবুল করেছে উদয়ন।

কিন্তু কেন আকাঙ্ক্ষাকে খুন করল জানতে চাওয়া হলেই সে মুখে কুলুপ এঁটেছে। আকাঙ্ক্ষাকে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা ধরা পড়াটাই কি খুনের কারণ? এক পুলিশ কর্তা বলেন, ‘‘উদয়ন চাকরি দেবে কী করে! জেরায় ও স্বীকার করেছে, ওর নিজেরই কোনও চাকরি ছিল না।’’

বাঁকুড়ার পুলিশ সুপারের অফিস থেকে বেরোচ্ছেন আকাঙ্ক্ষার বাবা-মা এবং ভাই। বুধবার রাতে অভিজিৎ সিংহের তোলা ছবি।

তা হলে তার চলত কী করে? তদন্তকারীরা জেনেছেন, ২০১০ সালে বাবা বীরেন্দ্র দাস ও মা ইন্দ্রাণীদেবীকে খুন করে, বাগানে পুঁতে দিয়ে রাইপুরের সুন্দরনগরের বাড়ি বেচে অন্তত ৪০ লক্ষ টাকা পায় উদয়ন। বাবা-মায়ের ভুয়ো ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ বানিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে তাঁদের রাখা মোটা টাকার ‘ফিক্সড ডিপোজিট’ও ভাঙিয়ে নেয়। সে টাকার কিছুটা ‘মান্থলি ইনকাম স্কিম’-এ, কিছুটা ‘সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে’ রেখেছিল। ভোপালের কোনও একটি ব্যাঙ্কে কারও যোগসাজসে সরকারি চাকুরে ইন্দ্রাণীদেবীর পেনশন বাবদ প্রাপ্য মাসিক ২০ হাজার টাকাও সে নিয়মিত তুলছিল। তা ছাড়া, সাকেতনগরে পৈতৃকবাড়ির একতলা ভাড়া দিয়ে সে মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা পেত। এই টাকার ভরসাতেই সে ‘ফেসবুক’-এ নিজেকে ধনী এবং উচ্চ প্রতিষ্ঠিত বলে দাবি করত এবং একাধিক বান্ধবী জোগাড় করেছিল। পুলিশ সূত্রের খবর, সাকেতনগরের তেমনই এক বান্ধবীকে নিয়ে উদয়ন চলতি মাসের ১ তারিখ সিনেমাও দেখতে গিয়েছিল। আকাঙ্ক্ষা-হত্যার পিছনে উদয়নের সেই বান্ধবীর ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

আরও পড়ুন:

উদয়ন খুন! মেয়ের নম্বর থেকে মেসেজ পেয়েছিল আকাঙ্ক্ষার পরিবার

কে বলবে খুনি! বাইরে উপচে পড়া ভিড়, চুল ঠিক করতেই ব্যস্ত উদয়ন

এ দিন সন্ধ্যায় উদয়নের জেরা চলার সময়ে পুলিশ সুপারের অফিসে ডেকে পাঠানো হয় আকাঙ্ক্ষার বাবা শিবেন্দ্র শর্মা, মা শশীবালাদেবী ও ভাই আয়ুষকে। পুলিশ সূত্রের দাবি, শিবেন্দ্রবাবুদের সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনও ঘটনা নিয়ে দু’পক্ষের বক্তব্য না মিললে, তাঁদের মুখোমুখি বসানোর কথা ভাবা হবে। শিবেন্দ্রবাবু পরে বলেন, ‘‘বাঁকুড়া পুলিশের তদন্তে আস্থা রয়েছে। আমরা বিচার চাই।’’ আকাঙ্ক্ষার পারলৌকিক কাজ সারতে আজ, বৃহস্পতিবার পটনা যাওয়ার কথা রয়েছে শর্মাদের।

Akansha US Death Udayan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy