মেদিনীপুর আদালতে ছত্রধরের স্ত্রী নিয়তি মাহাতো।
বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধে নামছে। আমলিয়া গ্রামে বাড়ির উঠোনে খাটিয়ায় চুপ করে বসে ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব বেদনবালা মাহাতো। টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির দোতলা বাড়িটার নিস্তব্ধতা খান খান করে দিচ্ছে পাশে বিয়েবাড়ির কোলাহল।
মাস দু’য়েক আগে বাবার শেষকৃত্যে প্যারোলে ছাড়া পেয়ে শেষ এই বাড়িতে এসেছিলেন জনগণের কমিটির নেতা ছত্রধর মাহাতো। সোমবার মেদিনীপুর আদালত তাঁকে ইউএপিএ মামলায় দোষী সাব্যস্ত করেছে। সে খবর অবশ্য তখনও জানতেন না বেদনবালাদেবী। আমাদের কাছে কথাটা শুনে চোয়াল শক্ত হল বৃদ্ধার। ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “রাজ্যটা তো মমতা দিদি চালান। ২০০৯ সালে আমার ছেলে যখন গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিল, কখন উনিই নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়া খাসজঙ্গলে এসে জনগণের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। ছত্রর সঙ্গে এক মঞ্চে সভা করেছিলেন। এখন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে উনি সব ভুলে গিয়েছেন।” বৃদ্ধার কটাক্ষ, “জনগণের আন্দোলন করতে গিয়ে আমার ছেলে অপরাধী হল, মমতাদিও তো তখন আমার ছেলেকে সমর্থন জানিয়ে একসঙ্গে সভা করেছিলেন, তাহলে তো উনিও অপরাধী!”
ইস্পাত কঠিন মুখে বৃদ্ধা তোপ দাগলেন এক সময়ের মাওবাদী নেত্রী তথা নিজের প্রাক্তন বৌমা সুচিত্রা মাহাতোর বিরুদ্ধেও। ছত্রধরের মেজভাই পুলিশের গুলিতে নিহত মাওবাদী শীর্ষ নেতা শশধর মাহাতোর স্ত্রী ছিলেন সুচিত্রা। বেদনবালাদেবী বলেন, “সুচিত্রা শত শত খুন করেও পার পেয়ে গেল। আর ছত্র, যে কোনও দিন একটা পিঁপড়েও মারেনি, সে হল অপরাধী। আমি মমতাদির কাছেই বিচার চাইব।”
মেদিনীপুর আদালতে ছত্রধর মাহাতো।
বৃদ্ধার বিলাপ শুনে ভিড় জমান পড়শিরা। আমলিয়ার বাসিন্দা সুমিত্রা মাহাতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “এটা ঠিক হল না। ছত্রধর মানুষের জন্য আন্দোলন করেছিল।” স্থানীয় কয়েক জন যুবকেরও বক্তব্য, “আমাদের অনেক কিছুই বলার আছে। কিন্তু আমাদের নাম লিখলে পুলিশ পিছনে লাগবে। তবে এটা ন্যায্য বিচার হল না।”
এ বার কেঁদে ফেলেন বেদনবালাদেবী। আঁচলের খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘‘এই যে জঙ্গলমহলের এত উন্নয়ন, সবই তো আমার ছেলের আন্দোলনের জন্য। সেই ছেলেই জেলে পচছে।”
ঠাকুমার বিলাপের কারণা প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি লালগড় সারদামণি বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী শিপ্রা। ছত্রধরের ছোট ভাই অনিলের এই মেয়েটি বড় জেঠুর (ছত্রধর) ভীষণ ন্যাওটা। ছত্রধর শিপ্রাকে আদর করে ‘মা’ বলেন। আর শিপ্রা জেঠুকে ডাকে ‘ব্যাটা’ বলে। শিপ্রা বলে, “জেঠিমা আজ মেদিনীপুরে গিয়েছেন। ভেবেছিলাম ব্যাটাকে আর বেশিদিন জেলে থাকতে হবে না। কিন্তু....”— গলা ধরে আসে কিশোরীর।
ছত্রধরের বড় ছেলে ধৃতিপ্রসাদ বাড়িতে ছিলেন না। ছিলেন না ছত্রধরের ভাই অনিলবাবুও। তবে ছত্রধরের ছোট ছেলে লালগড় কলেজের বিএ প্রথম বর্ষের পড়ুয়া দেবীপ্রসাদ মাহাতোর দেখা মিলল। তাঁর গলাতেও হতাশা। বললেন, “আশা ছিল, বাবা হয়তো বেকসুর খালাস পাবেন। আর কোনও আশা দেখছি না।”
সন্ধে সওয়া ছ’টা নাগাদ মেদিনীপুর থেকে থমথমে মুখে বাড়ি ফেরেন ছত্রধরের স্ত্রী নিয়তি। বড় বৌমাকে দেখে আচলে মুখ চাপা দিয়ে বাঁধ ভাঙা কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন বেদনবালাদেবী। শাশুড়িকে থামিয়ে নিয়তিদেবী বলেন, “কার কাছে বিচার চাইছ তুমি? প্রতিবাদ করলেই মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। তোমার নাতির নামও তো মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বার আমাদের নামেও হয়তো মামলা হবে। তবু শেষ দেখব। হাইকোর্টে যাব।” ছত্রধরের আইনজীবী কৌশিক সিংহ বলেন, ‘‘আমার মক্কেলের মতো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এমন এক নেতার প্রতি এই রায় দুর্ভাগ্যজনক। হাইকোর্টে মামলা লড়ার ক্ষেত্রে ওই পরিবারকে যথাসাধ্য সাহায্য করব।’’
বেদনবালাদেবীর বাড়ির উঠোনে যখন, অন্ধকার নেমে এসেছে। পাশের বিয়ে বাড়িতে অবশ্য আলোর রোশনাই। বেদনবালার কান্না আর বিলাপ চাপা পড়ে গেল সেই নহবতের সুরে!
সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy