দোকান বসানোকে কেন্দ্র করে দুই গোষ্ঠীর বচসা ও হাতাহাতি। সেই উত্তেজনা থেকে বুধবার রণক্ষেত্রের চেহারা নিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলা লাগোয়া রবীন্দ্রনগর এলাকা। পুলিশকে লক্ষ্য করে ছোড়া হল যথেচ্ছ ইট, পাথর। জ্বালিয়ে দেওয়া হল পুলিশের মোটরবাইক। হামলায় জখম হলেন কলকাতা পুলিশের ডিসি (বন্দর)-সহ কয়েক জন পুলিশকর্মী। পরে র্যাফ মোতায়েন করে এবং চার জন আইপিএসের নেতৃত্বে বাড়তি বাহিনী পাঠানো হলেও রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা এবং অশান্তি সামাল দিতে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠে গেল।
কয়েক ঘণ্টার এই তাণ্ডবের জেরে দ্রুত শুরু হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। পুলিশের কঠোর পদক্ষেপের দাবিতে এ দিন বিকালেই কয়েক জন বিজেপি বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমারের সাক্ষাৎ চেয়ে ভবানী ভবনে গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। ডিজি অবশ্য দেখা করেননি। পুলিশের ‘ব্যর্থতা’র প্রতিবাদে আজ, বৃহস্পতিবার বিধানসভা অচল করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা। পাল্টা তাঁর বিরুদ্ধে প্ররোচনার অভিযোগ এনেছে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। মুর্শিদাবাদে ‘হিন্দুদের আক্রান্ত হওয়া’ এবং পুলিশের গাফিলতির অভিযোগে বিধানসভায় সরব হওয়ার পরিকল্পনা আগেই নিয়েছে বিজেপি। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে মহেশতলা। মুর্শিদাবাদের পরে কলকাতার কাছে মহেশতলায় পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশের ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সিপিএম ও কংগ্রেসও। এ বারের ঘটনাস্থল তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারের অন্তর্গত বলে বাড়তি প্রশ্নও তুলছে বিরোধীরা।
স্থানীয় সূত্রের খবর, রবীন্দ্রনগরে ঘটনার সূত্রপাত একটি দোকান বসানোকে কেন্দ্র করে। এক ফল-দোকানি কয়েক দিনের জন্য দেশের বাড়িতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ফিরে দেখেন তাঁর দোকান সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এলাকায় ফিরে তিনি কয়েক জনকে ডেকে আনেন, দু’পক্ষের বচসায় হাতাহাতি শুরু হয়। সেই থেকেই ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনগর থানা সংলগ্ন এলাকা রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় বলে পুলিশ-কর্মীদের দাবি। এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘‘ভিড় করে লোক এসে বাড়িতে, দোকানে ঢুকে ভাঙচুর করেছে। মহিলাদের ধরে ধরে মারা হয়েছে। পুলিশ যত ক্ষণে এসেছে, পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গিয়েছে।’’ হামলার মুখে পড়ে এক পুলিশ-কর্মীকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘ওরা এত লোক, আমরা হাতেগোনা কয়েক জন। কী করব? প্রাণ বাঁচবে কি না, সেই ভয় করছিল!’’ এই সময়েই দেখা যায়, পাশ দিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক মহিলা পুলিশ-কর্মীকে। তাঁর মাথা ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। আর এক মহিলা পুলিশ-কর্মী কাঁধের যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘পাথর উড়ে এসে পড়েছে। গাড়ি থেকে নামতেই মারমুখী জনতার মুখমুখি পড়েছিলাম। বেঁচে গিয়েছি, এটাই বড় কথা।’’
রবীন্দ্রনগরের আক্রাফটক এলাকা থেকে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল পাশের কলকাতা পুলিশের নাদিয়াল থানা এলাকাতেও। পরে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন এডিজি দক্ষিণবঙ্গ এবং ডিআইজি প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ। রাত পর্যন্ত খবর, উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হলেও পরিস্থিতি থমথমেই রয়েছে ওই এলাকায়। পুলিশ সূত্রে খবর, রাজ্য এবং কলকাতা পুলিশ মিলিয়ে বেশ কয়েক জন আহত। অফিসার মদমর্যাদার পুলিশ-কর্মীর গাড়ির পাশাপাশি ভাঙচুর চালানো হয়েছে ঘটনাস্থলে যাওয়া কলকাতা পুলিশের বিশেষ বাহিনীর গাড়িতেও। ঘটনায় জখম ডিসি (বন্দর)-কে দেখতে সন্ধ্যায় হাসপাতালে গিয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের নগরপাল মনোজ বর্মা। ঘটনার পরেই রবীন্দ্রনগর থানা এলাকায় ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৬৩ ধারা (জমায়েত না করার আইন) জারি করা হয়েছে। সূত্রের খবর, যে চার জন আইপিএস অফিসারকে রাতের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছতে বলা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সদ্য জঙ্গিপুরের প্রাক্তন এসপি আনন্দ রায়। তাঁকে মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জের ঘটনার পরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এসপি পদ থেকে।
ভাঙড়, জঙ্গিপুরের পরে কলকাতা পুলিশ এলাকাতেও এ দিন পুলিশকে ‘অসহায়’ অবস্থায় দেখে প্রশ্ন উঠছে, এমন পরিস্থিতি যে তৈরি হতে চলেছে, তার কি আগাম কোনও তথ্য এবং সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি ছিল না বাহিনীর কাছে? এই ব্যাপারে পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া রাত পর্যন্ত মেলেনি। তবে পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, উত্তেজনা শুরুর কিছু ক্ষণের মধ্যেই রবীন্দ্রনগর থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল। কিন্তু হামলাকারীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় পিছু হটতে থাকে তারা। ধীরে ধীরে ডায়মন্ড হারবার পুলিশ জেলার রিজার্ভ ফোর্স ও কমব্যাট বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। বিকেলে কলকাতা পুলিশের বিশেষ বাহিনীও ডায়মন্ড হারবার পুলিশ জেলার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। পুলিশের বড় কর্তারা পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য মাইকে ঘোষণা করে অনুরোধ জানাতে থাকেন।
ভবানী ভবনে গিয়ে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অবশ্য অভিযোগ করেছেন, ‘‘পুলিশ ব্যর্থ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যর্থ। সারদার প্রমাণ লোপাটকারীকে বসিয়েছে (ডিজি পদে)। পাঁচ জন বিধায়ক নিয়ে ভদ্র ভাবে বলতে এসেছিলাম, আপনার পুলিশ মার খাচ্ছে, গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আদালতের নির্দেশ আছে, যখন ইচ্ছা আপনি কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইতে পারেন। আমাদের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করলেন না! নিজের ছেলেদের বাঁচাতে পারেন না, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে রয়েছেন।’’ তাঁর দাবি, ‘‘হিন্দুরা আক্রান্ত হয়েছে। আমি তাদের পাশে দাঁড়াব। বাকি কথা কাল বিধানসভায় হবে। বিধানসভা অচল করে দেব!’’ কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন এবং এনআইএ তদন্ত চেয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবকে চিঠি দিয়েছেন বিজেপির আইনজীবী-নেতা কৌস্তভ বাগচী।
কলকাতার মেয়র তথা মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম যদিও পাল্টা দাবি করেছন, ‘‘পুলিশ পুলিশের কাজ করছে। কোনও অপরাধী কিছু করলে ব্যবস্থা হবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’’ তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের মন্তব্য, ‘‘আহত হয়েও পুলিশ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। পুলিশের উপরে আস্থা রাখুন। বিরোধী দলনেতাকে বলব, এগুলোয় প্ররোচনা না দিয়ে পুলিশ-প্রশাসনকে সহযোগিতা করুন।’’ আর বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘বিধানসভা কেউ অচল করতে পারেন না। এমন কথা বলে সংসদীয় গণতন্ত্রকে অসম্মান করাও কোনও বিরোধী দলের কাজ হতে পারে না। বিরোধী দলের এই প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেই নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরা উচিত। বিরোধী দলনেতা বিধানসভার কর্মসূচিতে অংশ নেন না। তাই অচল করার কথা বলেন।’’
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর তোপ, ‘‘যে পুলিশ শিক্ষক বা নিরীহ প্রতিবাদীদের উপরে সক্রিয়তা দেখায়, তারাই এই ভাবে বিশৃঙ্খলা চলতে দিচ্ছে। মুর্শিদাবাদের মতো প্রশ্ন এখানে উঠতে বাধ্য। আর এ সবের জেরে তৈরি করা হচ্ছে মেরুকরণের পরিবেশ।’’ আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকারও বলেছেন, ‘‘পুলিশকে যদি স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেওয়া হত এবং শাসক দল এ রাজ্যের সংঘর্ষকারী ও সমাজবিরোধীদের মদত না দিত, তা হলে মহেশতলার মতো ঘটনা ঘটতো না।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)