Advertisement
E-Paper

কাঁপতে কাঁপতে গণতন্ত্রের উৎসব, কথা রাখল সকলে

কথা ছিল, রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ছ়ড়িয়ে থাকা ৯১টি পুরসভার ভোট শান্তিপূর্ণ হবে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগাম সে কথা জানিয়েছিলেন। হয়েছেও তা-ই। হতে পারে কাটোয়ায় গুলিতে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ইন্দ্রজিৎ সিংহ (৩৪) শাসক দল তৃণমূলেরই কর্মী হতে পারেন। হতে পারে কাটোয়াতেই দুই মহিলা-সহ আরও ৫ জন গুলিবিদ্ধ। হতে পারে বসিরহাটে এবং কলকাতার কাছে উত্তর শহরতলিতে দুষ্কৃতীরা গুলি চালিয়েছে। কিন্তু সে সবই ‘সামান্য ঘটনা’! ভোট হয়েছে শান্তিপূর্ণই!

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩২
ভোটের বলি। কাটোয়ায় তৃণমূল কর্মী ইন্দ্রজিৎ সিংহের দেহ আঁকড়ে কান্না আত্মীয়ার। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

ভোটের বলি। কাটোয়ায় তৃণমূল কর্মী ইন্দ্রজিৎ সিংহের দেহ আঁকড়ে কান্না আত্মীয়ার। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

কথা ছিল, রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ছ়ড়িয়ে থাকা ৯১টি পুরসভার ভোট শান্তিপূর্ণ হবে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগাম সে কথা জানিয়েছিলেন। হয়েছেও তা-ই। হতে পারে কাটোয়ায় গুলিতে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ইন্দ্রজিৎ সিংহ (৩৪) শাসক দল তৃণমূলেরই কর্মী হতে পারেন। হতে পারে কাটোয়াতেই দুই মহিলা-সহ আরও ৫ জন গুলিবিদ্ধ। হতে পারে বসিরহাটে এবং কলকাতার কাছে উত্তর শহরতলিতে দুষ্কৃতীরা গুলি চালিয়েছে। কিন্তু সে সবই ‘সামান্য ঘটনা’! ভোট হয়েছে শান্তিপূর্ণই!

কথা ছিল, পুলিশ-প্রশাসন দারুণ কাজ করবে। কলকাতার পুরভোটে তারা যেমন করেছিল। খুশি হয়েছিলেন পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী। কথা রেখেছে তারা। গোলমালে পৃথিবী দুলে উঠলেও পুলিশ মুখ ফিরে তাকায়নি বলেই বিরোধীদের অভিযোগ! পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলা-বজবজ বা মুর্শিদাবাদের কিছু এলাকা ছাড়া। তাকে অবশ্য ব্যতিক্রম বলতে হবে। বাকি সর্বত্রই বুথে ঢুকে যে যেমন ইচ্ছা কাজ করে গিয়েছে, বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্র (ইভিএম) তুলে নিয়ে চলে গিয়েছে, কখনও ভেঙেও ফেলেছে— এমন অভিযোগ এসেছে ভূরি ভূরি। বসিরহাটে পুলিশের সামনেই সাংবাদিকদের দিকে গুলি ছো়ড়া হচ্ছে দেখে ক্ষিপ্ত জনতা ইভিএম-টাই তুলে ভাঙচুর করেছে। বুথ চত্বরে ন্যূনতম বিধি-ব্যবস্থা মানেনি কেউ। কিন্তু ভোট-কর্মীরা নির্বাক! পুলিশেরও কোনও হেলদোল নেই। বরং, সশস্ত্র হয়েও পুলিশকে কোথাও কোথাও বুথ ঘিরে থাকা শাসক দলের বাহিনীকে করুণ স্বরে আর্জি জানাতে শোনা গিয়েছে, টানা এমন করলে কী করে হবে? মাঝে মাঝে তো সত্যিকারের ভোটারদেরও ঢুকতে দিতে হবে!

সিপিএমের দার্জিলিং জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকার, বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বা কংগ্রেস নেতা আবু হাসেম (ডালু) খান চৌধুরীরা অভিযোগ করেছেন, শাসক দল সর্বত্র দাদাগিরি চালিয়েছে। বিরোধী দলের এজেন্টদের বার করে দিয়েছে, ভোটারদের বাধা দিয়েছে। কিন্তু পুলিশ শুধু দূরে দাঁড়িয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে! শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা, মালদহের পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় বা দক্ষিণ দিনাজপুরের শীশরাম ঝাঝারিয়া—সকলেই এক সুরে জানিয়ে দিয়েছেন, বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছা়ড়া কিছুই ঘটেনি! তেমন কোনও অভিযোগও তাঁরা পাননি। যেমন কথা ছিল!

কথা ছিল, উৎসবের মেজাজে ভোট হবে। গণতন্ত্রের উৎসব। বলে রেখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। হয়েছেও তা-ই। ভোটের আগের রাত থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল উৎসব। তাতে সামিল হতে রাত থেকেই নানা পুর-এলাকায় ভিড় জমিয়েছিলেন রাজ্যের নানা প্রান্তের মানুষ। ভোটের শহরে তাঁরা ‘অতিথি’। সমালোচকেরা যাঁদের বলে থাকেন ‘বহিরাগত’! ভোরের আলো ফোটার আগে থেকেই তাঁদের উদ্দীপনা দেখে কে! বুথে যাওয়ার রাস্তা আগলে, ভোটার স্লিপ করায়ত্ত করে, ইভিএম কাউন্টারের সামনে ক্রমাগত নজরদারি চালিয়ে এবং বাইরে বেচাল দেখলেই বোমা ছুড়ে তাঁরা এ দিন গণতন্ত্রের উৎসবকে রীতিমতো মুখরিত করে তুলেছিলেন! কোথাও কোথাও ধরা পড়ে অবশ্য উৎসবের তাল একটু কেটেছিল। বাঁকুড়ায় যেমন সকাল সকাল ধরা পড়ে গিয়েছিলেন এক দল। বসিরহাটে বহিরাগতদের দেদার ছাপ্পা ভোটে বাধা না দিয়ে পুলিশ কেন এক স্থানীয় যুবককে ধরে নিয়ে গেল, এই অভিযোগে পুলিশের গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েছিলেন মহিলারা। বিরাটিতে মহিলারাই রাস্তা থেকে ইট-পাথর কুড়িয়ে তাড়া করেছিলেন ‘অতিথি’দের। কিন্তু এ সবই বিক্ষিপ্ত বাধা। অন্য ভাবে বললে ‘প্রতিরোধ’! এটুকু ছাড়া ‘অতিথি’দের কল্যাণে ভোট-উৎসব জমজমাট!

কথা ছিল, ৩১ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী নজরদারি চালাবে। কথা রেখেছেন জওয়ানেরা। যেখানে যতটুকু সংখ্যায় তাঁদের পাঠানো হয়েছে, তাঁরা দু’চোখ ভরে দেখে গিয়েছেন। গোলমাল থামাতে কেউ তাদের ডাকেনি। কেন্দ্রীয় বাহিনীও হস্তক্ষেপ করতে যায়নি।

কথা ছিল, রাজ্য নির্বাচন কমিশন অসহায় ভাব নিয়েই থাকবে। কলকাতার পুরভোটে যেমন ছিল। কার্যক্ষেত্রেও এর বিশেষ অন্যথা হয়নি। দিনের শেষে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় ভোট কেমন হল, তা নিয়ে মন্তব্যই করতে চাননি। তাঁর যুক্তি, তিনি কিছু বললে পাছে আবার বিতর্ক হয়! তবে মেনে নিয়েছেন, বিরোধীদের তরফে শ’খানেকের বেশি অভিযোগ এসেছে। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর নেতৃত্বে বাম নেতারা কলকাতায় মিছিল করে কমিশনের দফতরে গিয়ে জানতে চেয়েছেন, সুশান্তবাবু কবে পদত্যাগ করবেন? হাত-পা বাঁধা হয়ে যাওয়ায় কাজ করতে যদি না পারেন, পদ ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন? সুশান্তবাবু পরে জানিয়েছেন, এই নিয়েও কথা বলার সময় এখনও আসেনি! রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান, রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীও ভোট নিয়ে প্রশ্নের জবাবে শুধু বলেছেন, ‘‘আগে চূড়ান্ত রিপোর্ট আসুক। প্রাথমিক কিছু রিপোর্ট পেয়েছি শুধু।’’

কথা ছিল, তৃণমূল নেতারা কর্মীদের প্ররোচনায় পা দিতে বারণ করবেন। কিন্তু গোলমাল হচ্ছে খবর পেয়ে কেউ থামাতে সক্রিয় হবেন না। হয়েছেও তা-ই। শহরে শহরে দুষ্কৃতী দাপট চলছে যখন, তৃণমূল ভবন দিনভর নিরুত্তাপ! ভোট শেষে
শাসক দলের তরফে আনুষ্ঠানিক কোনও প্রতিক্রিয়াও নেই। প্রশ্নের জবাবে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় শুধু বলেছেন, ‘‘বিরোধীরা রাজনৈতিক ভাবে লড়ল কোথায়? বলার আর কী আছে! এমন ভূমিকম্পের দিনে এখন মানুষের পাশে দাঁড়ানোই বেশি জরুরি।’’

দিনভর মোলায়েম ভাবেই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন শাসক দলের কর্মী-সমর্থকেরা। কোথাও ভোট দিয়ে বেরোনো নির্দল প্রার্থী তথা স্থানীয় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষককে দেখে জনাকয়েক যুবক বলে দিয়েছেন, ‘‘মাস্টারমশাই, আপনার ভোট দেওয়া হয়ে গিয়েছে। এ বার সোজা বাড়ি চলে যান! বুঝতেই পারছেন, সময়টা ভাল নয়!’’ কোথাও বুথে ঢোকার আগেই অনুরোধ শুনতে হয়েছে, ‘‘আপনি বাবার বয়সী। তাই ভদ্র ভাবে বলছি, বাড়ি ফিরে যান! ভোট দেওয়ার দরকার নেই।’’ একটু উৎসাহী যাঁরা, তাঁদের অনেকে লাইনের জ্যাম টপকে বুথে ঢুকে আঙুলে কালি লাগিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু বহু জায়গায় ইভিএমের সামনে এগোতেই ‘‘আপনাকে ভাবতে হবে না। দিয়ে দিচ্ছি আমরা’’ বলে বোতাম টিপে দিয়েছেন শাসক দলের স্বেচ্ছাসেবকেরা!

এ সবই অবশ্য ভূমিকম্পের আগে। এমনিতেই উৎসবের মেজাজ বুঝে এবং ‘অতিথি’দের মূর্তি দেখে সকাল থেকে অনেকেই গৃহবন্দি ছিলেন বলে অভিযোগ। নির্বাচনের দিনগুলো সকাল সকাল বুথের সামনে যে লাইন দেখতে অভ্যস্ত এ রাজ্য, সেই চেনা ছবি এ বার ছিল না বহু জায়গাতেই। যাঁরা বেরিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে আবার বাধা পেয়ে ফিরেছেন।
তখনও ঝকঝকে সকাল। এর পরে আচমকাই ভূমিকম্প! কারা যেন রটিয়ে দিয়েছিল, ভূ-কম্পনে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রচুর। আতঙ্কিত মানুষ ভোটের লাইন ছেড়ে ছুটেছিলেন বাড়িতে। তাঁরা আর ফেরেননি।

বেলা ১২টার পর থেকে শেষ তিন ঘণ্টা ‘অতিথি’দের আর পায় কে! বুথে শুধু তাঁরা আর ইভিএম! আর পুলিশ, প্রিসাইডিং অফিসার, নির্বাচনী কর্মী? তাঁরা সব থেকেও ‘ভ্যানিশ’, বলছিলেন এক বিরোধী! আর এক বিরোধী টিপ্পনী কেটেছেন, ‘‘এত দিন মা আর মানুষ কাঁপছিলেন। এ বার মাটিও কেঁপে উঠল!’’ তবে কেউ কেউ আবার বলেছেন, তৃণমূলের কাছে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন আশীর্বাদ হয়ে ঝরে পড়ল!

স্বাভাবিক ভাবেই বিরোধীরা এ ভোটকে প্রহসন বলেছেন। বিমানবাবুর কথায়, ‘‘শিলিগুড়িতে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে তৃণমূলের ছক অনুযায়ী সব কিছু হয়নি। কিন্তু উত্তর ২৪ পরগনার ২৩টি পুরসভা-সহ দক্ষিণবঙ্গের ভোটকে তৃণমূল সম্পূর্ণ প্রহসনে পরিণত করেছে!’’

মানুষ যেখানে প্রতিবাদ করেছেন, সেখানে ছাড়া সব জায়গাতেই ভোট লুঠের চেষ্টা হয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ। গণনার আগে ইভিএম-ও এখন সুরক্ষিত নয় বলে তাঁর আশঙ্কা। আগামী ৩০ এপ্রিল দেশ জুড়ে পরিবহণ কর্মীদের ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছে সিটু। তেমন হলে পরিবহণ ধর্মঘটকে সামনে রেখে ওই দিনই হরতাল ডাকতে পারে বামফ্রন্ট। এটাও তো কথাই ছিল! বিরোধীরা তো এমন বলবেনই! বাম জমানার ৩৪ বছরে কত কী হয়েছে মনে নেই, আগের দিনই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

বিজেপি-র রাহুলবাবু আবার স্মৃতিশক্তিকে আরও প্রসারিত করে ফেলেছেন! পুরনো বিহার, উত্তরপ্রদেশের উদাহরণ মনে পড়ে গিয়েছে রাহুবাবুর। বলেছেন, ‘‘এর আগেও বহু রিগিং দেখেছি। কিন্তু তখন অন্তত বেলা ১১টা-১২টার পর থেকে গোলমাল হতো। এ বার নতুন বৈশিষ্ট্য দেখলাম— সকাল ৬টা থেকেই ভোটকেন্দ্রের দখল নিয়েছে সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা!’’ ভোটে হারবেন জেনে এ সব রাহুলবাবুদের অপপ্রচার, বলছেন তৃণমূল নেতারা। কথা তো ছিল তেমনই!

কথা তো ছিল। কিন্তু দরকার ছিল কি? ভোট-পর্ব সাঙ্গ হওয়ার পরে রাতে লজ্জিত কণ্ঠে শাসক দলের এক নেতার আক্ষেপ, ‘‘আমাদের যারা দেড় হাজার ভোটে জিতত, তাদের এ বার ৫ হাজার ভোটে জেতার শখ হল! বনগাঁ, কৃষ্ণগঞ্জের উপনির্বাচনে তো ফেয়ারলি অ্যান্ড স্কোয়্যারলি জিতেছিলাম। এ বারও বেশির ভাগ তেমনই জিততাম। কিন্তু যা হল, ৯১টা শহরের মানুষের কাছে আমাদের দল সম্পর্কে ভুল বার্তা চলে গেল!’’ বার্তা ভুল যাবে জেনেও রোখা গেল না কেন? পাল্টা প্রশ্ন আসছে, ‘‘কে রুখবে? যিনি পারতেন, তিনি তো আগাম বলে দিয়েছেন তাঁর কী কী (পুরসভা) চাই!’’

ভাইয়েরা শুধু কথা রেখেছেন! এবং ভুল প্রমাণিত করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে! যে প্রসঙ্গ তুলে এক নেতার কণ্ঠে শোনা গিয়েছে, ‘‘কে বলল কেউ কথা রাখেনি!’’

sandipan chakraborty Trinamool BJP Congress Election municipal bodies abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy