Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Syndicate

Syndicate: উত্তর থেকে দক্ষিণ জুড়ে বালিতে রক্তের দাগ

তদন্তের চাপে আপাতত কয়লা ও গরু পাচার  অনেকটাই বন্ধ। কিন্তু রমরমিয়ে চলছে দুর্নীতির অন্য চক্র।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০২২ ০৬:০৩
Share: Save:

২০১০ সালের ৩ জুন। সে দিনের ঘটনা এখনও ভুলতে পারেনি লাভপুরের বুনিয়াডাঙা গ্রাম।

সালিশি সভায় সে দিন তিন ভাইকে ডাকা হয়েছিল মনিরুল ইসলামের বাড়িতে। সেই মনিরুল, যিনি এর কয়েক বছর আগে ছিলেন সিপিএমেই। তার পরে যান ফরওয়ার্ড ব্লকে। ওই তিন ভাইও এক সময়ে ছিলেন সিপিএমে। তার পরে মনিরুলের সঙ্গেই দল বদল। কিন্তু বিরোধ তৈরি হয় এর পরেও। ২০০৯ সালে মনিরুল যোগ দেন তৃণমূলে। এর কয়েক মাসের মধ্যে তুঙ্গে ওঠে দু’পক্ষের তরজা। তখনই তিন ভাইকে সালিশি সভায় যোগ দিতে ডাকা হয় মনিরুলের বাড়িতে। কী হয়েছিল সেখানে, তা নিয়ে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ আছে। তবে মনিরুল পরে প্রকাশ্য সভায় ‘পায়ের তল দিয়ে পিষে মেরে’ ফেলার কথা শুনিয়েছিলেন।

রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় ফেলে দেওয়া সেই ঘটনার মূলে ছিল বালি খাদানের দখল। ঠিক এক যুগ পরে ২০২২ সালের ২১ মে বীরভূমেরই বগটুইয়ে ঘটে গেল চমকে দেওয়া আর এক হত্যাকাণ্ড, আদালতের নির্দেশে যার তদন্ত করছে সিবিআই। সেই ভাদু শেখ খুন এবং তার পরে কুপিয়ে, আগুন লাগিয়ে ১০ জনকে হত্যার পিছনেও রয়েছে একই কারণ। বালি-পাথর থেকে তোলা আদায়।

বাম থেকে তৃণমূল, যুগ যুগ ধরে চাকা ঘোরে। ক্ষমতা হাতবদল হয়। কিন্তু সংঘর্ষের পিছনে কারণ বদলায় না। কারবারের মুখ বদলেছে। বাকি সব এক আছে। ভাদু-খুনেও গল্পটা আলাদা কিছু নয়। সিবিআই জানতে পেরেছে, ভাদু খুনে যারা অভিযুক্ত, তারা চাইছিল সরাসরি ‘লুটের সাম্রাজ্যের’ দখল নিতে। তা করতে গেলে ‘পথের কাঁটা’ ভাদুকে সরাতেই হত।

অবৈধ বালি কারবারের এই ‘বিষচক্র’ শুধু বীরভূম নয়, ছড়িয়ে রয়েছে রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণের বহু জেলাতেই। রাজনৈতিক রক্তপাত তো আছেই, রেহাই পাচ্ছে না পরিবেশও।

কী ভাবে চক্র চলে: মোটা বালি, ঝিম বালি, মাঝারি বালি— কত তার রকমফের। খাদান থেকে বালি তোলা হল। আসল খেলা শুরু তার পর থেকে। যে পরিমাণ বালি বোঝাই করার কথা ট্রাক-লরি-ডাম্পারে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি তোলা হয়। এবং ‘বিনা বাধায়’ সে ট্রাক পৌঁছে যায় কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। বড় শহরগুলিতে বালি-পাথর সরবরাহের জন্য রয়েছে আর এক ‘সিন্ডিকেট’। তোলা থেকে পাচার— পুরো প্রক্রিয়াই চলে এক নিখুঁত ‘সিস্টেম’-এর মধ্যে। সঠিক হিসেব মিলবে না। তবে, রাজ্যে অবৈধ বালির কারবার বছরে কয়েকশো কোটি টাকার।

জাতীয় পরিবেশ আদালেতের নির্দেশে নদীবক্ষ থেকে ইচ্ছে মতো বালি তোলায় ২০১৬ সালেই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। কিন্তু, সে নির্দেশ কাগজেকলমে থেকে গিয়েছে বলেই অভিযোগ সর্বত্র। কোচবিহার, মালদহ, দুই দিনাজপুর থেকে বীরভূম, পূর্ব বর্ধমান, হুগলি বা পশ্চিম মেদিনীপুর— সর্বত্রই বৈধ খাদান থেকে যতটা বালি তোলার অনুমতি রয়েছে, তার থেকে বেশি বালি তোলাটাই দস্তুর। বৈধ খাদানের পাশাপাশি অবৈধ খাদানের সংখ্যাও বড় কম নয়। জলপাইগুড়ির মতো জেলা, যেখানে তিস্তায় কার্যত অনুমতি নেই, সেখানে অবৈধ খাদানই বেশি। একই ভাবে বাঁকুড়ায় দামোদর নদ লাগোয়া বড়জোড়া, মেজিয়া, সোনামুখী ব্লকের কিছু এলাকা এবং দ্বারকেশ্বরের পাড়ে কোতুলপুর, বিষ্ণুপুর ও ওন্দা ব্লকের নানা গ্রামে বেআইনি বালি খাদান চলার অভিযোগ উঠেছে। পূর্ব বর্ধমানে ১,০৫১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বালি খাদান রয়েছে। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর সূত্রের দাবি, প্রায় সম পরিমাণ এলাকা জুড়েই অবৈধ বালি খাদান রয়েছে। হুগলির আরামবাগ মহকুমায় দ্বারকেশ্বর, মুণ্ডেশ্বরী এবং দামোদরে অবৈধ খাদান থেকে দিনরাত বালি তোলা হচ্ছে।

কারা জড়িত: এই গোটা প্রক্রিয়াটার সঙ্গে পুলিশ এবং প্রশাসনের (বিশেষত ভূমি সংস্কার দফতর) একটা অংশের জড়িত থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে। তবে, আড়ালে শাসকদলের মদত রয়েছে বলেও অভিযোগ। শাসকদলের নেতাদের একাংশের মদতে প্রভাবশালী ঠিকাদারেরা বৈধ বালিঘাট চালান বলে যেমন জানা যাচ্ছে, তেমনই একাধিক নেতা ও জনপ্রতিনিধি তাঁদের ‘কাছের’ কিছু লোককে দিয়ে অবৈধ খাদান চালান বলেও অভিযোগ রয়েছে। অতি সম্প্রতি বীরভূমের নলহাটি-২ ব্লকের একটি গ্রামে ব্লক তৃণমূল সভাপতির আত্মীয়ই ব্রাহ্মণী নদী থেকে অবৈধ ভাবে বালি তুলছেন বলে অভিযোগ করেন গ্রামবাসীরা।

কবে থেকে চলছে: বহু বছরের এই কারবার। বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গে। তুলনায় ‘নবীন’ কারবার উত্তরবঙ্গে। ২০১৭ সাল থেকে খাদান থেকে ৫ বছরের লিজ়ে বালি তোলার নতুন নিয়ম চালু হয়। সেই নিয়মের ফাঁক গলেই চলে অবৈধ কারবার।

হিংসা-হানাহানি: অবৈধ বালির কারবার নিয়ে হানাহানি ও খুন-জখমে বীরভূম একেবারের সামনের সারিতে। লাভপুরেরই দাঁড়কায় ২০১৭ সালে বালিঘাটের দখলকে ঘিরে বোমাবাজিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৮ জন। জলপাইগুড়ি ওদলাবাড়িতেও অবৈধ বালির কারবার ঘিরে খুন হয়েছিলেন এক ব্যক্তি। পূর্ব বর্ধমানে এই কারবারকে ঘিরে রায়না, খণ্ডঘোষ, মঙ্গলকোটে অনেকগুলি খুন হয়েছে। কয়েক বছর আগে তৃণমূলের রায়না-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, সম্প্রতি মঙ্গলকোটের তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি খুনের পিছনেও বালি-দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে অভিযোগ। পিছিয়ে নেই হুগলি। ১৯৮০ সাল থেকে শুধু বালিকে কেন্দ্র করে ১১ জন খুন হয়েছেন।

তদন্তে কারা: বালি নিয়ে কোনও অভিযোগ উঠলে তদন্তে নামে স্থানীয় পুলিশ, ভূমি দফতর ও ব্লক প্রশাসন। সে তদন্তে বিরাট কোনও ফল যে হয়, তা নয়। খুনের মতো বড় ঘটনায় তদন্তে গতি আনতে অনেক সময় হস্তক্ষেপ করে রাজ্য পুলিশ। মাঝেমধ্যে অবৈধ বালি তোলা বন্ধে অভিযান চালানো হয় বটে, ক’দিন পরেই যে কে সেই।

শাস্তি হয়েছে কি: বেশ কিছু গ্রেফতারি, জরিমানা হয়েছে সব জেলাতেই। বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে নানা সময়ে বহু লোককে ধরা হয়েছে। এর বেশি খুব কিছু হয়নি। তবে, বালি ঘিরে বিস্ফোরণ, খুনের মতো ঘটনায় সক্রিয় হয় পুলিশ। গ্রেফতার করে বিচারপর্ব চলে। শাস্তিও হয়েছে। যদিও তাতে বালি-চক্রে ভাটা পড়ে না। (শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Syndicate Violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE