ভোটের আগে রাজ্যে গ্রুপ ডি পদে ৬০ হাজার লোক নিয়োগ করবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কিন্তু সেই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকতে রাজি নন রাজ্যের বহু আমলাই। কারণটা সেই পুরনো, রাজনৈতিক চাপের আশঙ্কা। তাই দায় এড়িয়ে নবান্নকে তাঁদের প্রস্তাব, স্বতন্ত্র বোর্ড গড়ে কর্মী নিয়োগ করা হোক কেন্দ্রীয় ভাবে। সরকারের শীর্ষ মহলে এই প্রস্তাব নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। যদিও পিছু ছাড়ছে না বিতর্ক।
এত দিন গ্রুপ ডি স্তরে নিয়োগ হতো স্থানীয় প্রশাসন বা দফতর মারফত। প্রশ্ন উঠছে, আচমকা কেন সেই দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চাইছে দফতরগুলি? সরকারি মহলের দাবি, সরাসরি ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে গ্রুপ-ডি নিয়োগের ঝুঁকি নিতে বহু আমলাই রাজি নন। এক অফিসারের ব্যাখ্যা: ২০১২-য় গ্রুপ ডি’তে মাত্র হাজার তিনেক পদে চুক্তি-নিয়োগ করতে গিয়েই পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে। অনেক অফিসার বদনামের ভাগী হয়েছিলেন। এ বার তো সংখ্যাটা ষাট হাজার!
তাই এ ক্ষেত্রে জটিলতা ও উপরতলার চাপের বহর আরও বাড়বে ভেবেই অধিকাংশ আধিকারিক বিষয়টির ছোঁয়াচ এড়িয়ে চলতে চাইছেন বলে আমলা মহলের ইঙ্গিত। বস্তুত বড় মাত্রার যে কোনও সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কেই আমলাদের সিংহভাগের মনে একটা ‘ভীতি’র মনোভাব কাজ করছে। যার প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রদেশের ব্যপম-কেলেঙ্কারির ছায়াও দেখতে পাচ্ছেন কেউ কেউ। অভিযোগ, ওই ঘটনায় ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি নিয়ে বিশাল টাকার খেলা হয়েছিল। তা ফাঁস হতেই দেশ জুড়ে তোলপাড় পড়েছে, জড়িয়ে গিয়েছে বিভিন্ন সরকারি অফিসার-সহ বহু বড় মাথার নাম। ব্যপম-তদন্তে সিবিআই-কে ডাকতে বাধ্য হয়েছে মধ্যপ্রদেশ সরকার।
নিয়োগ-বিতর্কের খামতি নেই এ রাজ্যেও। নবান্ন সূত্রের খবর: ২০১২-য় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষক নিয়োগের (টেট) পরীক্ষায় আর্থিক দুর্নীতির জোরালো অভিযোগ উঠেছিল। পরে মামলা হয়। নিয়োগ-প্রক্রিয়া বাতিল না-হলেও জলঘোলা হয়েছে বিস্তর, যার দায় অনেক ক্ষেত্রে অফিসারদের উপরে বর্তেছে। আবার হোমগার্ড নিয়োগ ঘিরে বিতর্কের স্মৃতিও টাটকা। এ বিষয়ে গত বছরই মুর্শিদাবাদের তৎকালীন এসপি দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন হোমগার্ডের তদানীন্তন ডিজি’র বিরুদ্ধে। সরকার শেষমেশ দু’জনেরই বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়।
এমতাবস্থায় ৬০ হাজার লোক নেওয়ার ফরমান শুনে সিঁদুরে মেঘ ঘনিয়েছে প্রশাসনের অন্দরে। নবান্নের একাধিক কর্তার আশঙ্কা, সরাসরি নিয়োগের সুবাদে শাসকগোষ্ঠী গ্রুপ ডি-তে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে ভোটের আগে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করবে। সেই চাপ উপেক্ষা করা অফিসারদের পক্ষে কঠিন হবে। উপরন্তু এত কম সময়ে এত লোক নিতে গেলে নানান অনিয়ম ঘটার প্রভূত সম্ভাবনা, যার দায় আখেরে আমলা-কর্মীদের ঘাড়েই চাপবে বলে ওঁদের আশঙ্কা।
ফলে অনেক অফিসার প্রক্রিয়াটির ধারে-কাছে ঘেঁষতে চাইছেন না। নবান্নের শীর্ষ মহলকে তাঁরা জানিয়েছেন, এত বিপুলসংখ্যক লোক নিয়োগের দায়িত্ব দফতরের হাতে না ছাড়াই উচিত। সেই মতো রাজ্যের কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতর ‘চতুর্থ শ্রেণি কর্মী নিয়োগ বোর্ড’ তৈরির প্রস্তাব পেশ করেছে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। তাতে বলা হয়েছে, বোর্ডের মাথায় প্রধান সচিব পদমর্যাদার কোনও অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসারকে রাখা হোক। থাকতে পারেন আরও জনা পাঁচেক সদস্য।
সেই বোর্ডই নিয়োগ-প্রক্রিয়া পরিচালনা করবে। তবে বোর্ড গঠনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশাসনের মধ্যে ইতিমধ্যে প্রশ্ন প্রকট। বর্তমানে গ্রুপ-ডি’তে লোক নেওয়া হয় স্থানীয় স্তরে, সরাসরি ইন্টারভিউয়ের ভিত্তিতে। ব্যাপারটা দেখেন জেলাশাসক বা এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারেরা। কখনও আবার সংশ্লিষ্ট দফতর দায়িত্ব নেয়। প্রশাসনের একাংশের দাবি: এই ব্যবস্থায় কিছুটা হলেও নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা বজায় থাকে। কিন্তু নিয়োগের সব ক্ষমতা বোর্ডের হাতে গেলে সবটাই হবে কেন্দ্রীয় ভাবে, যাতে স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির সুযোগ বেশি। এই মহলের পর্যবেক্ষণ, ভোটের মুখে সরাসরি ৬০ হাজার চাকরি দেওয়াটাকে শাসক দল পুরোপুরি রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইতে পারে। ‘‘নিয়োগ-পদ্ধতি কেন্দ্রীয় ভাবে হলে তো পছন্দের
লোক ঢোকাতে মহা সুবিধা,’’ মন্তব্য এক আধিকারিকের।
প্রস্তাব মোতাবেক, বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ থাকবে মুখ্যমন্ত্রীর অধীনস্থ কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতরের হাতে। তবে বোর্ড তৈরির জন্য আলাদা আইন করা হবে, নাকি স্রেফ আদেশনামা জারি করেই সরকার গ্রুপ-ডি নিয়োগে নামবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। সূত্রের ইঙ্গিত, প্রয়োজনে প্রশাসনিক ফতোয়া জারি করেও নিয়োগ-প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
মাত্র ক’মাসে এত লোক নেওয়া কি সম্ভব? নবান্নের প্রবীণ অফিসারেরা অনেকেই সন্দিহান। অতীত উদাহরণ টেনে তাঁরা বলছেন, বাম জমানায় একটি দফতরে কয়েকশো লোক নেওয়ার ঘোষণা হতেই আবেদনপত্র জমা পড়েছিল কয়েক লক্ষ। সেই নিয়োগ নিয়ে বহু অভিযোগও উঠেছিল।
এ বার ৬০ হাজার লোক নিতে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। তার উত্তরে ৩০ লাখ আবেদন পড়লেও আশ্চর্যের কিছু নেই। অত আবেদনপত্র যাচাই, যোগ্যদের ইন্টারভিউয়ে ডেকে সফল প্রার্থীদের তালিকা তৈরি— এই কর্মকাণ্ড সাত মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন ওই অফিসারেরা। সংশয়টা ঘুরছে প্রশাসনিক মহলেও। তবে প্রত্যেকেরই বক্তব্য, গ্রুপ-ডি’তে ৬০ হাজার চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। বিধানসভা ভোটের আগেই তা করতে হবে। ‘‘কী ভাবে, সেটা বিবেচ্য নয়। যে কোনও উপায়ে কাজটা করতে হবে,’’ মন্তব্য এক শীর্ষ কর্তার।
৬০ হাজার গ্রুপ-ডি ছাড়াও কেরানি ও শিক্ষক পদে ৭০ হাজার করে— ভোটের আগে দু’লক্ষ ছেলেমেয়ের চাকরি হবে বলে মমতা ঘোষণা করেন।
নবান্নের খবর, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষক নিয়োগের ভার প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড ও স্কুল সার্ভিস কমিশনের হাতে।
সেখানে আবেদনপত্র গ্রহণ শেষ হয়েছে। কেরানি নিয়োগের দায়িত্বে স্টাফ সিলেকশন কমিশন (এসএসসি)।
মামলা মোকদ্দমার প্যাঁচে শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। খতিয়ান বলছে, চার বছরে কমিশন আড়াই হাজার কেরানি নিয়োগ করতে পেরেছে। এ বারও তাদের তরফে সরকারকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ৭০ হাজার পদে লোক নিতে গেলে সব মিলিয়ে অন্তত এক-দেড় বছর তো লাগবেই!
অর্থাৎ, পদ্ধতিগত কারণেই ভোটের আগে শিক্ষক-কেরানি মিলিয়ে ১ লক্ষ ৪০ হাজার লোককে চাকরি দেওয়া সহজ হবে না। এটা বুঝেই নবান্নের শীর্ষ স্তর থেকে গ্রুপ-ডি নিয়োগে জোর দেওয়া হচ্ছে বলে প্রশাসনিক সূত্রের ইঙ্গিত। পাশাপাশি ক’দিন আগে রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডির কাছে মুখ্যমন্ত্রী পুলিশে শূন্য পদের তালিকা চেয়ে পাঠান। ডিজি সরকারকে জানিয়েছেন, ২০ হাজার কনস্টেবল, ২৪০০ এএসআই ও ২০০০ এসআইয়ের চাকরি হতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীর অফিস তাড়াতাড়ি তা সেরে ফেলতে চাইছে।
সরকারের এই নিয়োগ-তৎপরতা দেখে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রশ্ন, ‘‘শূন্য পদে লোক নিলে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু তা নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হবে তো?’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, ‘‘এ বার চিটফান্ড নেই। তাই ভোটের আগে দেদার চাকরি বিলিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা তোলার ফন্দি করছে তৃণমূল।’’ সরকারের কী বক্তব্য? তৃণমূলের মহাসচিব তথা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় যাবতীয় অভিযোগ-আশঙ্কা-প্রশ্ন উড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনের মূল মন্ত্রই হল স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা। যোগ্যতম প্রার্থীদের বেছে নিতে পুরোপুরি নিয়ম মেনে নিয়োগ হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy