Advertisement
E-Paper

কোলে করে ক্লাসে পৌঁছে দেয় দাদারা

দু’বছর আগে ছেলের পড়াশোনা করার জেদের কাছে হার মেনে স্থানীয় বাংলা মাধ্যম স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করেন তার মা। শারীরিক ও আর্থিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এখন সে সপ্তম শ্রেণি।

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৮ ০৪:০১
পাশে-থাকা: অরিজিৎকে ক্লাসে পৌঁছে দিচ্ছে উঁচু ক্লাসের দাদারা। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

পাশে-থাকা: অরিজিৎকে ক্লাসে পৌঁছে দিচ্ছে উঁচু ক্লাসের দাদারা। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

‘ডাকঘর’-এর অমল জানলার পাশে বসে অপেক্ষা করত, কখন একটু গল্প করার লোক পাবে। আর বালির অরিজিৎ জানলার গ্রিল ধরে ভাবত, কত ক্ষণে ছুটে বেরিয়ে পড়বে স্কুলের পথে!

যদিও সে ভাবনা এক সময় ঘুমিয়ে পড়ত ছোট্ট অরিজিতের মনের মধ্যেই। কারণ তার এক ছুটে বেরিয়ে যাওয়ার পথে বাধা, সেরিব্রাল পলসি। তাই হাঁটতে, দাঁড়াতে পারে না অরিজিৎ। তবু দু’বছর আগে ছেলের পড়াশোনা করার জেদের কাছে হার মেনে স্থানীয় বাংলা মাধ্যম স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করেন তার মা। শারীরিক ও আর্থিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এখন সে সপ্তম শ্রেণি।

এই ‘যুদ্ধে’ পাশে দাঁড়িয়েছে তার স্কুল ‘বালি শিক্ষানিকেতন।’ উঁচু ক্লাসের দাদারাই দরকার পড়লে কোলে করে তাকে দোতলায় পৌঁছে দেয়। কারণ দোতলাতেই ল্যাবরেটরি, আইসিটি (ইনফর্মেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি)-র ক্লাস। আর তাই অরিজিতের কথা ভেবে একতলা থেকে দোতলায় ক্লাস ঘর স্থানান্তরিত করা, একতলার বারান্দায় হুইলচেয়ার ওঠানোর জন্য র‌্যাম্প বানানোর পরিকল্পনা করেছেন কর্তৃপক্ষ।

বাড়ি থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের স্কুলে আসা-যাওয়ার জন্য টোটোর বন্দোবস্তও করেছে স্কুলই। প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ মিস্ত্রি বলেন, ‘‘ছাত্রটি খুবই মেধাবী। ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছে প্রথম হয়ে। ওর সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত।’’

স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি সুব্রত গোস্বামী জানান, মাঝেমধ্যেই ফাঁকা ক্লাসঘরে হুইলচেয়ারে মনমরা হয়ে বসে কাঁদত অরিজিৎ। জিজ্ঞাসা করতে জানা যায়, সহপাঠীরা দোতলায় ক্লাসে গেলেও, সে যেতে পারছে না। সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘এর পরেই দোতলায় ক্লাসঘর স্থানান্তরিত করার চিন্তাভাবনা হয়েছে। টোটো ভাড়াও স্কুল থেকে দেওয়া হবে। সকলে পাশে দাঁড়ালে ও আরও এগোতে পারবে।’’

বালির ওই স্কুলের উদ্যোগ সকলের কাছে উদাহরণ হতে পারে বলে মনে করেন চিত্র পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘হাজার ছাত্রের মধ্যে এক জনের জন্য কেন করব, এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু এক জনই বা তার পূর্ণ বিকাশের জন্য সব রকম অধিকার থেকে বাদ থাকবে কেন? স্কুলের এই পদক্ষেপই অন্যকে সাহস জোগাবে।’’

বালির ফটিকচন্দ্র পাঠক লেনের বাসিন্দা মিলিদেবী রোজ হুইলচেয়ার ঠেলে স্কুলে নিয়ে আসতেন ছেলেকে। তার পর সহায় অন্য ছাত্ররা। তারাই হুইলচেয়ার তুলে ধরে ক্লাসে পৌঁছে দিত অরিজিতকে। বেঞ্চের পাশে হুইলচেয়ারে বসেই পড়াশোনা করে ওই ছাত্র। মিলিদেবী বলেন, ‘‘আমার তো বয়স হচ্ছে। রোজ হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে যেতে পারি না। একটা টোটো ভাড়া করলেও টাকার অভাবে তা বন্ধ হতে বসেছিল। জানতে পেরে স্কুল পাশে দাঁড়ায়।’’ টাকা নেই বলেই এক বছর আগে থেকে বন্ধ অরিজিতের ফিজিওথেরাপি। দু’বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেকে মানুষ করতে প্রতিবেশী ও পরিচিতদের বাড়িতে জামাকাপড় ফেরি করেন মিলিদেবী। আয় খুবই সামান্য। অরিজিতের পিসি মায়া ঘোষ বলেন, ‘‘ফিজিওথেরাপি করে হাঁটুটা কিছুটা নরম হওয়ায় ছেলেটা ওয়াকার নিয়ে অল্প হাঁটতে পারত। তা-ও এখন বন্ধ।’’ ঘরে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটে ওই ছাত্র। তবে স্কুল ছাড়া বেশির ভাগ সময়টাই কাটে রাস্তার পাশের ঘরের বিছানায় শুয়ে। প্রিয় বিষয় তার বিজ্ঞান ও ইংরেজি।

পড়ন্ত বিকেলে পাড়ার মাঠে যখন সমবয়সীরা ফুটবল দাপায়, ঘরে একা অরিজিৎ স্বপ্ন দেখে গবেষক হওয়ার!

Education Cerebral Palsy সেরিব্রাল পলসি Arijit
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy