Advertisement
E-Paper

দিনে ১ লক্ষ ২০ হাজার! লুঠের দখল ধরে রাখতে গিয়েই কি বিস্ফোরণ নারায়ণগড়ে?

বৃহস্পতিবার সকালে পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড় ব্লকে তৃণমূলের একটি পার্টি অফিসে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছে। ঝাঁ-চকচকে পার্টি অফিস মুহূর্তে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৮ ২০:০২
মকরামপুরে তৃণমূলের সেই পার্টি অফিস, বিস্ফোরণের পর যা ধ্বংসস্তূপ।

মকরামপুরে তৃণমূলের সেই পার্টি অফিস, বিস্ফোরণের পর যা ধ্বংসস্তূপ।

একটা কারখানাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল তিনটি অঞ্চলের রাজনৈতিক সমীকরণ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, শাসক দলের অন্দরের সমীকরণ। শ্রমিকদের মজুরি কেটে নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা লুঠ চলছিল প্রতি মাসে। মকরামপুর, পাকুড়সেনী, নারায়ণগড় থেকে অন্তত তেমনই অভিযোগ উঠে আসছে বৃহস্পতিবার সকালের বিস্ফোরণের পরে। ওই অভিযোগকে ঘিরেই জমছিল ক্ষোভের আগুন। পাল্টা বারুদও জমা করা হচ্ছিল বলে খবর। সেই বারুদেই কি উড়ে গেল তৃণমূলের মকরামপুর পার্টি অফিস? জল্পনা তেমনই। দুষ্কৃতীদের যে জড়ো করা হয়েছিল, সে ইঙ্গিত মিলছে স্থানীয় বিধায়কের মন্তব্যেও।

বৃহস্পতিবার সকালে পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড় ব্লকে তৃণমূলের একটি পার্টি অফিসে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছে। ঝাঁ-চকচকে পার্টি অফিস মুহূর্তে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সুদীপ্ত ঘোষ নামে এক তৃণমূল কর্মী ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছেন। আরও চার জন গুরুতর জখম। এক জন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।দু’জনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কলকাতায়। আর এক জনকে ওডিশার কটকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁর একটি হাত ও একটি পা বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। রাতে তাঁর মৃত্যু হয়। তৃণমূল অবশ্য সে বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি।

নারায়ণগড়ের বিস্ফোরণের অভিঘাত নারায়ণগড়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ‘আওয়াজ’ শোনা গিয়েছে গোটা রাজ্যেই। স্বাভাবিক ভাবেই সব নজর ঘুরে গিয়েছে নারায়ণগড়ের দিকে। তাতেই উঠে আসতে শুরু করেছে চাঞ্চল্যকর নানা অভিযোগ।

নারয়ণগড়ে বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন যুবক।

নারায়ণগড়ের পাকুড়সেনী গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় একটি নামী ব্র্যান্ডেরপ্লাস্টিকের আসবাবপত্র তৈরির একটি কারখানা রয়েছে। নারায়ণগড়, মকরামপুর এবং পাকুড়সেনী— এই তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাতেই বেশ কিছু দিন ধরে শাসক দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ওই কারখানাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছিল বলে খবর।

আরও পড়ুন
ফরেন্সিক তদন্ত চাইলেন বিধায়ক নিজেই​

যে পার্টি অফিসে বিস্ফোরণ ঘটেছে বৃহস্পতিবার সকালে, সেটি লক্ষ্মী শীটের পার্টি অফিস নামে পরিচিত। লক্ষ্মী শীট তৃণমূলের মকরামপুর অঞ্চল কমিটির সভাপতি। মকরামপুর এলাকায় লক্ষ্মী শীটের দাপট সর্বজনবিদিত। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ওই গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৩টি আসনের সবক’টিই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তৃণমূল। সৌজন্য লক্ষ্মীবাবুর দাপট। এলাকায় বিরোধী কণ্ঠস্বর প্রায় নেই। তাই কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস করছেন না। কিন্তু বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা আড়ালে আবডালে বলছেন, মকরামপুর পার্টি অফিসে এ দিন সকাল সকাল বৈঠকে বসেছিলেন লক্ষ্মী শীট,রঞ্জিত বসু এবং সূর্যকান্ত অট্ট। দলবল নিয়ে বৃহস্পতিবার ওই কারখানায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁরা। বর্তমান ঠিকা শ্রমিকদের আটকে দিয়ে নতুন ঠিকা শ্রমিক ঢোকানোর পরিকল্পনা হয়েছিল। প্রয়োজনে সংঘর্ষে যাওয়ারও প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। এলাকায় শোনা যাচ্ছে এমনই নানা কথা।

নারায়ণগড় ব্লকে আড়াআড়ি বিভাজন রয়েছে তৃণমূলের সংগঠনে। ব্লক সভাপতি মিহির চন্দ এবং বিধায়ক প্রদ্যোৎ ঘোষ এক দিকে। আর জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ সূর্যকান্ত অট্ট অন্য দিকে। পাকুড়সেনী এবং মকরামপুর অঞ্চল তৃণমূলের সভাপতি রঞ্জিত বসু এবং লক্ষ্মী শীটের সঙ্গে সম্প্রতি সূর্যকান্ত অট্টের ঘনিষ্ঠতাই বেশি বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। আর নারায়ণগড় অঞ্চল তৃণমূলের সভাপতি গৌরাঙ্গ জানা হলেন মিহির-প্রদ্যোৎদের দিকে।

ওই কারখানায় ঠিকা শ্রমিক সরবরাহ করার কারবার বেনামে রঞ্জিত বসু চালাচ্ছিলেন বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। স্থানীয় সিপিএম কর্মীদের দাবি, ‘মা ব্রহ্মাণী’ নামে একটি সংস্থার মাধ্যমে শুরুতে শুধু সাফাইকর্মী সরবরাহ করতেন তৃণমূল নেতা রঞ্জিত বসু। আর শ্রমিক সরবরাহ করত ‘শাইন প্লাস্টিক’ নামে একটি সংস্থা। পরে সেই সংস্থার কর্তাদের হঠিয়ে দিয়ে ঠিকা শ্রমিকদের কর্তৃত্বও রঞ্জিত বসু নিজে নিয়ে নেন বলে অভিযোগ। শ্রমিকদের জন্য রোজ কারখানা কর্তৃপক্ষ যে টাকা দিতেন, তার অনেকটাই রঞ্জিতবাবু কেটে নিতেন বলেও অনেকের দাবি।

আরও পড়ুন
মমতার পরশ এ বার ‘রুগণ্‌’ নারায়ণগড়ে​

যে কারখানাকে ঘিরে এই গোলমাল, সেই কারখানার শ্রমিকদের একাংশই জানিয়েছেন যে, ওই নামী সংস্থা দিন প্রতি ৩৫১ টাকা করে দিলেও, ঠিকাদারের হাত ঘুরে শ্রমিকদের হাতে পৌঁছয় সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা। কারও কারও ক্ষেত্রে সেটা ২৪০ টাকা বা ২৩০ টাকাতেও দাঁড়ায় বলে অভিযোগ। অর্থাৎ, প্রত্যেক শ্রমিকের মজুরি থেকে কমপক্ষে ১০০ টাকা করে রোজ কেটে নেওয়া হয় বলে তাঁদের দাবি।

বিস্ফোরণের পর...

ওই কারখানায় ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যাপ্রায় বারোশো। প্রত্যেকের মজুরি থেকে ১০০ টাকা করে কাটলে এক দিনেই ঠিকাদারের হাতে যায় ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। মাসিক আমদানি ৪০ লক্ষ। খবর তেমনই।

আশেপাশে অন্যান্য কারখানাতেও ঠিকা শ্রমিক রেখে কাজ হয়। কিন্তু সেই সব কারখানায় ঠিকাদাররা শ্রমিকদের মজুরি থেকে দিনে ২০-৩০ টাকার বেশি কমিশন নেন না। এই আসবাবপত্র তৈরির কারখানার শ্রমিকদের ক্ষোভ জন্মায় সেখান থেকেই।

গত সোমবার কাজ বন্ধ করে দিয়ে কারখানার গেটে অবস্থান শুরু করেন ঠিকা শ্রমিকরা। মজুরি থেকে রোজ কেন ১০০ টাকা করে কেটে নেওয়া হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তুলেই অবস্থান শুরু হয়। খবর পেয়ে বিধায়ক প্রদ্যোৎ ঘোষ হস্তক্ষেপ করেন। তিনি ধর্মঘট তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানান শ্রমিকদের। আলোচনা করে সমস্যা মিটিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

বিধায়কের অনুরোধে সোমবার কারখানার গেট থেকে অবরোধ উঠে যায় ঠিকই। কিন্তু শ্রমিকরা তৎক্ষণাৎ কাজে যোগ দেননি। তাঁরা মিছিল করে নারায়ণগড় পার্টি অফিসে পৌঁছন। বিধায়ক প্রদ্যোৎ ঘোষ এবং ব্লক সভাপতি মিহির চন্দ পার্টি অফিসে উপস্থিত ছিলেন। ডেকে পাঠানো হয়েছিল রঞ্জিত বসুকেও। নেতৃত্বের ধমক এবং শ্রমিকদের সম্মিলিত বিক্ষোভের মুখে রঞ্জিত কথা দেন, শ্রমিকদের মজুরি থেকে অত টাকা করে আর কাটা হবে না। খবর তৃণমূল সূত্রেরই। রঞ্জিত বসুকে কারখানার কোনও বিষয়ে নাক না গলানোর নির্দেশ দেন বিধায়ক। খবর তেমনই। সে দিনের মতো সেখানেই মেটে এই সমস্যা।

তবে এর পরেই সূর্যকান্ত অট্ট পাল্টা সক্রিয় হন বলে একাংশের অভিযোগ। কারখানার বর্তমান ঠিক শ্রমিকদের বসিয়ে দিয়ে নতুন শ্রমিক ঢোকানোর পরিকল্পনা হয় বলে খবর। নারায়ণগড়, পাকুড়সেনী ও মকরামপুর অঞ্চলে সূর্য অট্ট গোষ্ঠীর লোকজনকে সেই মতো বৃহস্পতিবার সকালে মকরামপুর পার্টি অফিসে জড়ো হতে বলা হয় এবং সেখানে বোমা-আগ্নেয়াস্ত্রও মজুত করা হয়। দাবি স্থানীয়দের একাংশের। দলবল নিয়ে ওই কারখানার গেট আটকে দেওয়া হবে, বর্তমান ঠিকা শ্রমিকদের আর ঢুকতে দেওয়া হবে না, তার জায়গায় নতুন লোকজন ঢুকিয়ে মাসে ৪০ লক্ষ টাকা আমদানির রাস্তা মসৃণ রাখা হবে— এই রকমই ‘প্ল্যান’ হয়েছিল বলে শ্রমিকদের একাংশের অভিযোগ। কারখানা অভিযানের জন্য জমা করা বোমাতেই বিস্ফোরণ ঘটেছে এ দিন সকালে— দাবি তাঁদের।

নারায়ণগড়ে সেই বিস্ফোরণস্থল।

তৃণমূলের কোনও নেতাই কিন্তু খুব স্পষ্ট করে মুখ খুলতে চাইছেন না বিষয়টি নিয়ে। বৃহস্পতিবার সকালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের সভাপতি অজিত মাইতি বলেন, ‘‘বিস্ফোরণের খবর পেয়েছি। নানা রকম কথা শুনছি। কেউ কেউ বলছেন গ্যাস সিলিন্ডার ফেটেছে। পুলিশ-প্রশাসনকে খোঁজ নিতে বলেছি। দলের তরফ থেকেও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।’’ জেলার দীর্ঘদিনের নেতা তথা তৃণমূল সাংসদ মানস ভুঁইয়া সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান প্রশ্ন। তিনি বলেন, ‘‘আমি তো পুরুলিয়া যাচ্ছি। আমি ঠিক জানি না ব্যাপারটা।’’ আর বিকেলে কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলন করে তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমার কাছে এখনও বিশদ খবর এসে পৌঁছয়নি। তবে বিজেপি মস্তান নামিয়ে ভয় দেখিয়ে এ রকম করছে।’’

অজিত-মানস-পার্থরা বিষয়ের গভীরে যেতে চাননি ঠিকই। কিন্তু বিধায়ক প্রদ্যোৎ ঘোষের কথায় ওই কারখানাকে কেন্দ্র করে ঘনিয়ে ওঠা সঙ্কটের ইঙ্গিত কিছুটা মিলেছে। কারখানার ঠিকা শ্রমিকদের মজুরিকে কেন্দ্র করে যে গোলমাল, তার জেরেই এই বিস্ফোরণ? বিধায়ক বললেন, ‘‘তা বলতে পারব না। তবে শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে একটা সমস্যা হচ্ছিল। শ্রমিকরা ধর্মঘটেও গিয়েছিলেন। আমি ফোন করে বলেছিলাম, ধর্মঘট করা চলবে না। আলোচনা করে সমস্যা মেটানো হবে। কিন্তু তার জন্য আগে কাজ শুরু করতে হবে।’’

শ্রমিকদের নিয়ে এবং দলের অন্য গোষ্ঠীকে নিয়ে তিনি বৈঠক করেছেন কি না, সে বিষয়টি প্রদ্যোৎবাবু খোলসা করেননি। তবে তিনি বলেন, ‘‘আমি বলেছিলাম ত্রিপাক্ষিক বৈঠক করতে হবে। কারখানা কর্তৃপক্ষ, শ্রমিক এবং দল— তিন পক্ষ আলোচনায় বসে সমস্যা মিটিয়ে নেবে।’’

কারখানায় ঠিকা শ্রমিক সরবরাহের বরাত দখলকে কেন্দ্র করেই কি এত বড় কাণ্ডটা ঘটে গেল মকরামপুর পার্টি অফিসে? বিধায়ক এ প্রশ্নের কোনও স্পষ্ট জবাব দিতে চাননি। বরং বলেছেন, ‘‘আমার মনে হয় ওগুলো অপপ্রচার।’’ তবে মকরামপুরে লক্ষ্মী শীটের পার্টি অফিসে বিস্ফোরণটা যে নেহাৎ সিলিন্ডার বিস্ফোরণ নয়, তা-ও কথার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘এই ঘটনার পিছনে কারা রয়েছে, তা আমরা দেখছি। পুলিশ-প্রশাসনকেও বলেছি, দরকার হলে ফরেন্সিক তদন্ত করুন। কিন্তু কী করে এত বড় কাণ্ডটা ঘটল, সেটা খুঁজে বার করুন। বৃহস্পতিবার সকালে ওই পার্টি অফিসে কারা ছিল, ওখানে কী হচ্ছিল, কারা এর নেপথ্যে রয়েছে, পুলিশকে খুঁজে বার করতে বলেছি।’’

ছবি: সংগৃহীত।

Narayangarh Blast TMC নারায়ণগড়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy