সরকারের অভিযোগ। জুটমিল-মালিকেরা খাড়া করছেন পাল্টা যুক্তি। চাপান-উতোরের ফাঁক গলে পুকুর চুরি হচ্ছে। নিম্ন মানের চটের বস্তায় উপচে পড়ছে বাজার।
এমতাবস্থায় বড় হয়ে উঠছে প্রশ্ন— বস্ত্র মন্ত্রকের তরফে উপযুক্ত নজরদারি বা সক্রিয়তা কি রয়েছে?
এ ব্যাপারে সরকারের আত্মতুষ্টির জায়গা যে বিশেষ নেই, বিভিন্ন মহলে সে ইঙ্গিত প্রকট। এ-ও শোনা যাচ্ছে, বস্তার মান ঠিকঠাক রাখার স্বার্থে যতটা কড়াকড়ি দরকার, অনেক ক্ষেত্রে তাতে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। বস্তুত খোদ মন্ত্রকেরই অভিযোগ, মানরক্ষার নির্ধারিত মাপকাঠি অধিকাংশ চটকল মানছে না। কী রকম?
মন্ত্রকের রিপোর্ট মোতাবেক, ২০১৩-য় মানের মাপকাঠিতে ২৪টি জুটমিলের মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে মাত্র দু’টি। ২০১৪-য় ২৬টির মধ্যে ৪টি। ২০১৫-র ১৪ অক্টোবর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বস্তার ৮৩টি বান্ডিল সরবরাহের আগে পরীক্ষা করা হয়েছিল। উতরোয় সাকুল্যে ছ’টি!
বেগতিক দেখে চটকল-মালিকেরা জুট কমিশনারের কাছে দরবার করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, মাপকাঠি অত্যন্ত কঠিন, তাই তা শিথিল করা হোক। সরকার মেনেও নেয়। তার পরেও পরিস্থিতির ইতরবিশেষ হয়নি। রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১৫-র ১৪ অক্টোবরের পর থেকে চলতি বছরের ১০ অগস্ট পর্যন্ত ৪১৪টি কনসাইনমেন্ট যাচাই করা হয়েছে। শিথিল শর্ত মেনে পাশ করেছে ১০২টি।
অর্থাৎ, পণ্যের মান বাড়ানোর তাগিদ এখনও নেই। উপরন্তু মন্ত্রকের রিপোর্টের দাবি, বেশ কিছু চটকলের মালিকপক্ষ নিজেদের প্রয়োজন মতো কাঁচা পাটের দামে হেরফের ঘটিয়ে বেআইনি কারবার করছেন। যেমন, ২০১৫-র নভেম্বরে বাজারে আচমকা কাঁচা পাটের দাম চড়চড়িয়ে বাড়তে শুরু করেছিল। রফতানি থেকে শুরু করে দেশীয় বাজারে পাট কেনা-বেচার উপরে যার তুমুল প্রভাব পড়ে। ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দিল্লিকে আর্জি জানায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। প্রশ্ন ওঠে, এ কি অবৈধ মজুতদারির পরিণাম? মন্ত্রক কাঁচা পাট মজুতে নিয়ন্ত্রণও জারি করে দেয়।
এবং কিছু দিনের মধ্যে রাজ্যের নির্দেশে এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ (ইবি) তল্লাশিতে নামে। চারটি জুটমিল ও দুই মজুতদারের হেফাজত থেকে উদ্ধার হয় প্রচুর পরিমাণ কাঁচা পাট। দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনাপ্রবাহের সূত্র ধরে নজরদারিতে গাফিলতির কথাও উঠে আসে।
সংশ্লিষ্ট চটকল কোম্পানিগুলির তরফে অবশ্য সব অস্বীকার করা হয়েছে। মন্তব্য এড়িয়ে অভিযুক্ত মালিকেরা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে জুট কমিশনারের রিপোর্ট চেয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট, তাই কিছু বলা উচিত হবে না। ওঁদের কেউ কেউ আবার ‘ষড়যন্ত্রের’ গন্ধও পাচ্ছেন। এক মালিকের কথায়, ‘‘আমাদের বদনাম করতেই এ সব করা হচ্ছে। কোথাও কখনও হয়তো সামান্য কিছু নেপালের বস্তা উদ্ধার হয়েছে। হইচই করে বলার চেষ্টা হচ্ছে, আমরা সবাই নেপাল থেকে মাল কিনে বিক্রি করি!’’ ওঁর প্রশ্ন— ‘‘এমনটা হলে আমরা শুধুমুধু মিল চালাব কেন? শ্রমিকেরাই বা মানবেন কেন?’’ আর মন্ত্রকের রিপোর্ট প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে চটকল মালিকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান জুটমিল অ্যাসোসিয়েশন (আইজেএমএ)-এর চেয়ারম্যান রাঘবেন্দ্র গুপ্ত দিয়েছেন সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘এমন কিছুর কথা আমার জানা নেই। তাই মন্তব্য করব না।’’
অন্য দিকে চট-মালিকদের ‘অবৈধ কীর্তিকলাপ’ প্রসঙ্গে মন্ত্রকের গোপন রিপোর্টে যথেষ্ট সারবত্তা দেখছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। সিটু’র বেঙ্গল চটকল মজদুর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অনাদি শাহু যেমন বলছেন, ‘‘সব অভিযোগ ঠিক। মিল-মালিকেরা নেপাল, বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত বস্তা কিনে এনে নিজেদের ছাপ্পা লাগিয়ে বেচছেন।’’ তাঁর আক্ষেপ— এতে শ্রমদিবস কমছে, শ্রমিকেরা কাজ হারাচ্ছেন। অথচ কেন্দ্রের হেলদোল নেই। ‘‘উল্টে পাটজাত দ্রব্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনার ধুয়ো তুলে দিল্লি ওই সব জুটমিলের পিছনে কোটি কোটি টাকা ঢালছে!’’— মন্তব্য অনাদিবাবুর।
শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রের খবর: কাঁচা পাট বাজারে আসে জুলাই-অগস্টে। তার আগেই কেন্দ্রের তরফে দাম বেঁধে দেওয়ার কথা। কিন্তু অভিযোগ, কোনও বছরই তা হয় না। সরকারি ঢিলেমির খেসারত দিতে হয় চাষিকে। পাশাপাশি শ্রমিক নেতাদের অনেকেরই অভিযোগ, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৫৮টি জুটমিল শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি, পিএফ, ইএসআইয়ের প্রায় সাতশো কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। তবু কেন্দ্র উদাসীন, রাজ্যেরও মুখে কুলুপ।’’
এ সবেরই প্রতিবাদে আগামী ১৮ নভেম্বর আইজেএমএ-র অফিসে বিক্ষোভ অভিযানের কর্মসূচি নিয়েছে বেঙ্গল চটকল মজদুর ইউনিয়ন।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy