Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

প্রেমে ঘরছাড়া, তরুণীকে পিটিয়ে কাটানো হল চুল

স্বামীর ঘর ছেড়ে পরপুরুষের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ‘শাস্তি’ সালিশি সভা বসিয়ে ১০৮ বার কঞ্চির বাড়ি। ছ’হাজার টাকা ‘জরিমানা’।

নিগৃহীতা। —নিজস্ব চিত্র।

নিগৃহীতা। —নিজস্ব চিত্র।

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়
নওদা শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৩২
Share: Save:

স্বামীর ঘর ছেড়ে পরপুরুষের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ‘শাস্তি’ সালিশি সভা বসিয়ে ১০৮ বার কঞ্চির বাড়ি।

ছ’হাজার টাকা ‘জরিমানা’।

এবং তা দিতে না পারায়, বরকেও মারধর করে ঘরপালানো বৌয়ের চুল কাটতে বাধ্য করা।

তালিবানি এলাকা নয়, ঘটনাস্থল মুর্শিদাবাদের নওদা। হুমকি ছিল, এই নিয়ে যেন থানা-পুলিশ না হয়। তবু তিন দিন পরে পুলিশের কানে খবর ওঠে। দু’জন গ্রেফতারও হয়েছে। বাকি জনা পাঁচেক এখনও ফেরার।

নওদার চাঁদপুরের যে তরুণী ঘর ছেড়েছিলেন, তাঁর বিয়ে হয়েছিল ১৪ বছর আগে। বয়স বছর তিরিশ। বারো আর আট বছরের দুই ছেলে, ছ’বছরের মেয়ে রয়েছে তাঁদের। স্বামী দিনমজুরি করেন। স্থানীয় গলিপাড়ায় তাঁদের টানাটানির সংসার।

পুলিশকে তরুণীটি জানিয়েছেন, নদিয়ার তেহট্ট থেকে আসা এক গরু-ছাগলের কারবারির সঙ্গে সম্প্রতি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাঁর চেয়ে বছর দশেকের বড় সেই লোকটিও বিবাহিত। তবু দু’জনে ঠিক করেন, বিয়ে করবেন। দিন দশেক আগে দু’জনে পালিয়ে দুর্গাপুরে চলে যান। পরে তেহট্টে কারবারির বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। কিন্তু সেখানে তুমুল অশান্তি বাধে। কারবারি তা সামাল দিতে পারেননি। বাধ্য হয়ে দিন সাতেক পরে চাঁদপুরে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন তরুণী। ছেলেমেয়েদের মুখ চেয়ে স্বামী তাঁকে ফিরিয়েও নেন।

কিন্তু খোদার উপরে খোদকারি করার লোক কোথায় নেই? পাড়ার কিছু লোকজন চাপ দিতে থাকায় তরুণীর স্বামী মোড়লদের ‘পরামর্শ’ চান। তাঁদের বাড়ির সামনেই সালিশি সভা বসে। হাজির ছিলেন আট জন মোড়ল আর জনা পঞ্চাশেক পাড়া-পড়শি। মোড়লেরা ফতোয়া দেয়— পরপুরুষের সঙ্গে ঘর ছাড়া অপরাধ। তার শাস্তি প্রহার। তাদের নির্দেশে পাড়ারই এক যুবক বাঁশের কঞ্চি দিয়ে সপাং সপাং করে মারতে থাকে তরুণীকে, গুনে-গুনে ১০৮ বার।

দাঁতে দাঁত চেপে মার খান তরুণী। কিন্তু তাতেও রেহাই মেলেনি। নিদান হয়— এই সভাতেই ছ’হাজার টাকা ‘জরিমানা’ দিতে হবে। ঠিক যে ভাবে প্রায় সব সালিশি সভায় জরিমানার নামে কার্যত তোলাবাজি চলে। কিন্তু নুন আনতে যাঁদের পান্তা ফুরোয়, তাঁরা এ টাকা জোগাড় করবেন কোথা থেকে? তরুণী বলেন, ‘‘আমরা ওদের হাতে-পায়ে ধরে দু’হাজার টাকায় রফা করার চেষ্টা করি। বারবার বলি, আমি ভুল করেছিলাম। কিন্তু কোনও কথাই শুনতে চায়নি ওরা। টাকা দিতে না পারায় আমার স্বামীকেও বারবার পেটানো হয়।’’

কিছুতেই টাকা আদায় করা যাবে না বুঝে শেষমেশ মোড়লেরা তরুণীর স্বামীকে বলে— ‘‘ওর চুল কেটে দে, যাতে ওই চুল দেখিয়ে আর কোনও পুরুষকে কাবু করতে না পারে!’’ বাধ্য হয়ে সেখানেই সকলের সামনে কাঁচি দিয়ে স্ত্রীর চুল ছেঁটে দিতে বাধ্য হন স্বামী। পরে তিনি বলেন, ‘‘দুই ছেলে আর এক মেয়ের মুখ চেয়ে স্ত্রীর ভুল মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু মোড়লেরা যা করল, তা বলার নয়।’’

পাড়ার লোকেরা কী করছিল?

রবিবারের ওই সালিশি সভায় হাজির ছিলেন ফরমান আলি। তাঁর দাবি, ‘‘আমি সকলের পিছনে ছিলাম। কোনও কথা বলিনি। ইচ্ছে থাকলেও প্রতিবাদ করতে পারিনি।’’ আবার সফর আলি নামে এক জনের বক্তব্য, ‘‘স্বামী ও সন্তান থাকতে পরপুরুষের সঙ্গে পালানো বড় অপরাধ। পাড়ার বড়রা তার শাস্তি দিয়েছে, যাতে এটা দেখে আর কেউ এ কাজ করার সাহস না দেখায়।’’

মোড়লেরা শাসিয়ে গিয়েছিল, এই সব কথা যেন পাড়ার বাইরে না যায়। তবু খবরটা চাপা থাকেনি। কানাঘুষো হতে-হতে নওদা থানাতেও পৌঁছয়। বুধবার পুলিশ তরুণী ও তাঁর স্বামীকে থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তরুণী বলেন, ‘‘গত দু’দিন ভয়ে আর লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পারিনি। তবে আজ পুলিশকে সব কথা খুলে বলেছি।’’ শুধু মুখে বলাই নয়, সাত জনের নামে লিখিত অভিযোগও দায়ের করেছেন তিনি। তার ভিত্তিতে এ দিনই ইমাদুল শেখ ও লিটন শেখ নামে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিরা পালিয়েছে। তাদের খোঁজে পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে।

গত দু’দিন এলাকার নেতারা কী করছিলেন? চাঁদপুরেরই বাসিন্দা তথা নওদা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সাহাবুদ্দিন মোল্লার দাবি, ‘‘এ দিন সকালেই ঘটনাটা প্রথম আমার কানে আসে। মধ্যযুগীয় বর্বরতা ছাড়া এটা কিছু নয়! অভিযুক্ত সকলকে পুলিশ গ্রেফতার করুক।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

woman hair chopped
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE