Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ডাইনি অপবাদে পিটিয়ে খুন

জানগুরু-সহ ৭ জনের ফাঁসির সাজা

বিচার হল। ডাইনি অপবাদে তিন মহিলাকে পিটিয়ে খুন করার দায়ে এক মহিলা-সহ সাতজনকে ফাঁসির সাজা শোনালেন বিচারক। একই সঙ্গে ছ’জনকে যাবজ্জীবন (আমৃত্যু) এবং একজনকে দিলেন ন’বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ।

এজলাসে তোলা হচ্ছে জানগুরু সমাই মণ্ডলকে। —নিজস্ব চিত্র

এজলাসে তোলা হচ্ছে জানগুরু সমাই মণ্ডলকে। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
ঘাটাল শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৬ ০২:৪৯
Share: Save:

বিচার হল। ডাইনি অপবাদে তিন মহিলাকে পিটিয়ে খুন করার দায়ে এক মহিলা-সহ সাতজনকে ফাঁসির সাজা শোনালেন বিচারক। একই সঙ্গে ছ’জনকে যাবজ্জীবন (আমৃত্যু) এবং একজনকে দিলেন ন’বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ।

সাড়ে তিন বছরে অনেকটাই বদলেছে দাসপুরের দুবরাজপুর। শুধু কয়েকটা মানুষের মুখের কথায় যে গ্রামের মানুষ পিটিয়ে মেরেছিল তিন মহিলাকে। সেই গ্রামেরই কিশোরী বলে বেড়াচ্ছে ‘ডাইনি বলে কিছু হয় না।’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন পড়ে শোনাচ্ছে মা-কাকিমাকে। তবু তার উপলব্ধি, ‘‘আমরা যতই বলি, সচেতন হতে আরও সময় লাগবে।’’

দুবরাজপুরের মানুষ বলছেন চরম শাস্তিতে জানগুরুদের আধিপত্য কমবে। তাঁদের ঘরের মানুষগুলো আজ শাস্তির মুখে শুধুমাত্র জানগুরুর উস্কানিতে। মা, দিদির খুনে বিচার চেয়ে এতদিন অপেক্ষা করেছিলেন বছর তিরিশের বুধু সিংহ। তিনি বলেন, “সবচেয়ে বেশি রাগ ওই জানগুরু সমাই মাণ্ডির উপরেই। ও-ই গ্রামের মানুষের হাতে বাঁশ তুলে দিয়েছিল। ওর ফাঁসি হোক।” হরিরাজপুরের বোবা সিংহও বলেন, “সন্ধ্যা বেলা আমার স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল মাতব্বরেরা। জানগুরুর নিদানে ওকে মেরে পুঁতে দিয়েছিল। সবাই শাস্তি পাক।” স্থানীয় ভারতী সিংহ বললেন, “এখনও বহু জানগুরু রয়েছে। ওদের জন্যই তো গ্রামের আজ এই অবস্থা। সব জানগুরুরা শাস্তি পেলেই শান্তি।”

শনিবার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি গ্রামের মানুষকে বার বার পড়ে শুনিয়েছে আদিবাসী পাড়ার অসীমা সিংহ। স্থানীয় স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়া অসীমা এ দিন বলে, “আমাদের সমাজে অনেকেই ডাইন কথাটি অন্ধভাবে বিশ্বাস করে। এখনও। তবে ওই ঘটনার পর আর কেউ এ নিয়ে একটি বাক্যও উচ্চা‌রণ করেনি।”

ওই মামলায় তিন বছর জেল খেটে বেকসুর খালাস পেয়েছেন গণেশ সিংহ। এ দিন প্রায় চেঁচিয়ে উঠে ওই যুবক বলেন, “আমি আর ওই সব কথায় নেই বাবু। আমার শিক্ষা হয়ে গিয়েছে।” সকাল থেকেই টিভি দেখার জন্য ছটফট করছিলেন বৃদ্ধ সাহেব সিংহ। তাঁর বৌমা কুনি জেলে। বেলা ৩টে নাগাদ ঘাটালের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক দেবপ্রসাদ নাথ, কুনিকে যাবজ্জীবনের আদেশ শোনান।

দুপুর ২টো থেকে শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। শুক্রবারই সাত মহিলা-সহ মোট ১৪জনকে দোষী সব্যস্ত করেছিলেন বিচারক। এ দিন বেলা ৩টের সময় মঙ্গল সিংহ, কালী সিংহ, সমাই মাণ্ডি, সানি মাণ্ডি, ভাকু সিংহ, নুরা সিংহ ও রবীন সিংহকে ফাঁসির আদেশ শোনান। কুনি সিংহ, জয়ন্তী সিংহ, চাঁদমনি সিংহ, পঞ্চমী সিংহ, ছবি সিংহ ও লক্ষ্মী সিংহকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন। সঙ্গে ষাট হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে একবছরের কারাদণ্ড। সুকুমার সিংহ খুনের মামলায় সরাসরি যুক্ত না-থাকায় তাঁকে ন’বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন। সুকুমারকে তথ্য প্রমাণ লোপাট ও বেআইনি জমায়েতের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

সরকারি আইনজীবী শীর্ষেন্দু মাইতি বলেন, “এটি একটি বিরল থেকে বিরলতম ঘটনা। জেলায় ডাইনি অপবাদে খুনের ঘটনায় এতজনের সর্বোচ্চ সাজা এই প্রথম।” রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা বললেও আসামী পক্ষের এক আইনজীবী জয়দেব মুখোপাধ্যায়ও রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, “এই ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। আসল অপরাধীরা অধরা।”

উল্লেখ্য, এই ঘটনায় মোট ৪৯ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছিল। পুলিশ মোট ২২জনকে গ্রেফতার করেছিল। বিচার চলাকালীন দু’জন মারা যান। বাকিরা এখনও পলাতক।

ঘাটালের আইনজীবীরাও এই রায়ে খুশি। বরদা বাণীপীঠ হাইস্কুলের শিক্ষক উদয় ঘটক ও সুকুমার পানের মতে, ছাত্ররাও যাতে তাদের পাড়ায় এমন ঘটনার প্রতিবাদ করে, তাও শেখাতে হবে।

দিনের শেষে বিচারকের আদেশ শুনে বুধু সিংহ আর বোবা সিংহের মুখে ম্লান হাসি। তাঁদের আশা, ‘‘এ বার সরকার আমাদের সমাজ থেকে জানগুরুদের বিদায় দিলেই শান্তি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

lynching witch Woman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE